পর্যটনকেন্দ্র মন্দারমণিতে ‘অবৈধ’ ঘোষিত ৬৩টি হোটেল ও লজকে বৈধতা দিতে উদ্যোগী হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন দফতর। আইন দফতরের দাবি, উপকূল-বিধির যে নিষেধাজ্ঞা এত দিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাতে ২০১১-র সংশোধনের সুবাদে হোটেলগুলিকে স্বীকৃতি দিতে এখন সমস্যা হবে না। যদিও সরকারের উদ্যোগ ঘিরে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
রাজ্যের সমুদ্র-বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের একাংশের বক্তব্য: আইনের ব্যাখ্যা যা-ই হোক, এ ভাবে বেআইনি নির্মাণকে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। তাঁদের আশঙ্কা, মন্দারমণির হোটেলগুলো বানানোই হয়েছে তট-বিধি লঙ্ঘন করে। এখন তা আইনেরই স্বীকৃতি পেয়ে গেলে ভবিষ্যতে সংশোধিত বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফের ওই তল্লাটে নির্মাণকাজ হবে। এবং পরবর্তী সময়ে সেই সব অবৈধ নির্মাণও বৈধতা পেয়ে যাবে বলে ওঁদের আশঙ্কা।
দিঘা, শঙ্করপুর, মন্দারমণি। ‘উইক এন্ড’ কাটাতে পূর্ব মেদিনীপুরের এই তিন পর্যটনকেন্দ্র এখন আম-বাঙালির বেশ পছন্দের জায়গা। এদের মধ্যে মন্দারমণি সবচেয়ে দেরিতে যাত্রা শুরু করেছে। আর গোড়া থেকেই সেখানে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সমুদ্রের গা ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন হোটেল ও লজ। কেন?
কেন্দ্রীয় উপকূল এলাকা নিয়ন্ত্রণ (সিআরজেড) বিধি মোতাবেক, উপকূল-অঞ্চলে জোয়ারের সময়ে যত দূর পর্যন্ত সমুদ্রের জল পৌঁছায়, তার পাঁচশো মিটারের মধ্যে কোনও নির্মাণকাজ করা যায় না। পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিযোগ: বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী মন্দারমণির হোটেল ও লজগুলো পাঁচশো মিটারের সেই ‘গণ্ডি’ মানেনি। এক সময় কলকাতা হাইকোর্ট সেগুলোকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছিল। রাজ্যের পরিবেশ দফতর তাদের এখনও ছাড়পত্র দেয়নি। কিন্তু তার পরেও সিআরজেড বিধির তোয়াক্কা না-করে মন্দারমণির সমুদ্র সৈকতে একের পর এক হোটেল, লজ, অতিথিশালা গড়ে উঠেছে। |
সমুদ্রের গা ঘেঁষে সুরম্য হোটেল। তটে চলছে গাড়িও। —নিজস্ব চিত্র |
এ হেন বিতর্ক গায়ে মেখেই গত প্রায় দু’দশক ধরে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে মন্দারমণি। ওখানে তট-বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের ফয়সালার ব্যাপারে রাজ্যের পূর্বতন বাম সরকার কার্যত হাত গুটিয়ে ছিল। এখন রাজ্যের বর্তমান সরকারের দাবি: সিআরজেড বিধিতে গত বছরের নতুন সংশোধনীর সাহায্যেই মন্দারমণির হোটেলগুলোকে বৈধতা দেওয়া যেতে পারে। রাজ্য আইন দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “সংশোধিত সিআরজেড বিধিতে যা বলা হয়েছে, তাতে হোটেলগুলোকে বৈধতার স্বীকৃতি দেওয়ায় কোনও বাধা নেই।” কী ভাবে?
রাজ্য আইন দফতরের ব্যাখ্যা: ২০১১-য় কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রক সিআরজেডে যে সংশোধনী এনেছে, তাতে (সিআরজেড-১) বলা হয়েছে, উপকূলের ওই নির্ধারিত পাঁচশো মিটারের মধ্যে নতুন করে কোনও নির্মাণ করা যাবে না। এমনকী, সম্প্রসারণ প্রকল্পও করা যাবে না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের এই সংশোধনীরই ভিত্তিতে রাজ্য আইন দফতর মনে করছে, সমুদ্রতটের পাঁচশো মিটারের মধ্যে যে সব নির্মাণ আগে থেকেই রয়েছে, সেগুলো থাকতে আর কোনও বাধা রইল না।
বস্তুত সংশোধিত বিধির এমন একটা ব্যাখ্যাই আইন দফতর পাঠিয়েছে পর্যটন দফতরকে। তারা বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ দফতরের সঙ্গে আলোচনা করেছে। রাজ্যের পর্যটন-সচিব বিক্রমবাবু বলেন, “আইন দফতরের ব্যাখ্যা নিয়ে পরিবেশ দফতরের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে শীঘ্রই।” রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার অবশ্য সতর্ক। তাঁর মন্তব্য, “মন্দারমণির হোটেলগুলোর ব্যাপারে কী করা যায়, তা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।”
তবে সরকার যে ভাবেই চাক না কেন, আদতে বিধি ভেঙে সমুদ্রসৈকতে গড়ে ওঠা হোটেলকে বৈধতা দেওয়ার ঘোরতর বিরোধী পরিবেশবিদ ও সমুদ্র-বিজ্ঞানীদের অনেকে। যেমন সমুদ্র-বিজ্ঞানী আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের দাবি: ওই তল্লাটে হোটেল নির্মাণকে কলকাতা হাইকোর্ট বেআইনি ঘোষণা করেছিল। রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও তাদের ছাড়পত্র দেয়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাম আমলে একটা কমিটি গড়া হয়েছিল, কমিটি রিপোর্টও দিয়েছিল। কিন্তু তদানীন্তন সরকার তা কার্যকর করেনি। “উপকূলের হৃৎপিণ্ড হল বেলাভূমি। অথচ মন্দারমণিতে সেই বালিয়াড়ি কেটেই পরের পর হোটেল তৈরি করা হয়েছে!” আক্ষেপ আনন্দদেববাবুর।
এবং বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও বিধির বাধা অমান্য করে গজিয়ে ওঠা ওই সব নির্মাণকেই এ বার বৈধতার তকমা দিতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। তার আঁচ টেরও পাওয়া যাচ্ছে। পর্যটন-সচিব বিক্রমবাবু জানিয়েছেন, “দ্রুত সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে পর্যটন দফতর হোটেলগুলোর রেজিস্ট্রেশন করাবে। তাদের লাইসেন্স দেবে সংশ্লিষ্ট পুরসভা বা পঞ্চায়েত।” ‘উদ্যোগ’টি বাস্তবায়িত হলে বিতর্কের নতুন পথও খুলে যাবে বলে মনে করছে নানা মহল। |