বয়স তখনও দু’অঙ্ক ছোঁয়নি। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত প্রলয়। বায়না ধরেছিল, মাটি এনে দিতে হবে। ছেলের কথা শুনে বাবা প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছুটা মাটি এনে দিয়েছিলেন। সে বারেই প্রথম অপটু হাতে সেজে উঠেছিলেন মা দুর্গা।
দেখতে দেখতে কোন্নগরের বিশালাক্ষী সড়ক ছোট কালীতলার বাসিন্দা, সেই প্রলয় বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার মাধ্যমিকের দোরগোড়ায়। সময় যত এগিয়েছে, ততই নিখুঁত হয়েছে তার সৃষ্টি। পরীক্ষার প্রস্তুতির ফাঁকেও সময় বের করে এ বার আড়াই ফুটের দুর্গা তৈরি করেছে সে। পুজোও করবে নিজেই। ভাড়া বাড়ির এক কোণে তার প্রতিমা দেখতে এখন থেকেই লোক ভিড় করছেন। সময় পেলে পুজোর বাদ্যিও নিজেই বাজাবে প্রলয়।
প্রবীরবাবু জানালেন, প্রথম দু’বছর নারকেল কাঠি আর মাটি দিয়েই প্রলয় মূর্তি গড়ত। ২০০৭ সাল থেকে রীতিমতো কাঠামো তৈরি করে খড় দিয়ে ছেলের মূর্তি গড়া শুরু। ২০০৯ সালে প্রলয় যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, সে বার দেবীর কাপড়-রং আনা হয় কুমোরটুলি থেকে। পরের বছর প্রলয় তৈরি করে শোলার সাজের প্রতিমা।
উল্টোরথে কাঠামো পুজো দিয়ে শুরু হয় প্রলয়ের দুর্গাপ্রতিমা গড়ার কাজ। যাবতীয় রীতি মেনে পুজোর পরে দশমীতে কোন্নগর সাধুর ঘাটে হয় বিসর্জন। এ বারেও তাঁর তৈরি প্রতিমার কথা লোকের মুখে মুখে। প্রতিমার মুখাবয়ব থেকে মাটির কাপড়ের সুদৃশ্য পাড় সবেতেই শিল্পমনস্কতার ছোঁয়া। স্বল্পভাষী ছেলেটির কথায়, “মনে যা আসে, সে ভাবেই মা-কে তৈরি করি।” |
ছেলেবেলায় অবশ্য পুজোয় মন্ত্রের তেমন বালাই ছিল না। তবে নিষ্ঠা ছিল পুরোদস্তুর। ২০১০ সালে পৈতে হওয়ার পর থেকেই ষষ্ঠীতে বোধন, অষ্টমীতে সন্ধিপুজো-সহ যাবতীয় আচার মেনে পুজো করে সে। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে পুজো হয়। জ্যাঠামশাই প্রণববাবু আচার শিখিয়ে দেন। মা মাধবীদেবীও সাহায্য করেন। ভোগ রান্না হয়। ২০১০ সালে প্রলয়কে ‘শারদ-সম্মান’ দেয় কোন্নগর পুরসভা। দিদি প্রমা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলার ছাত্রী। ভাইয়ের হাতের কাজে তিনিও মুগ্ধ। আর বাবা বলেন, “আমাদের পরিবারে কেউ কখনও মাটির কাজ করেছে, শুনিনি। ছেলেকে দেখে কিন্তু তা বোঝাই যায় না। অবশ্য শুধু মাটি কেন, যে কোনও কাজেই ও স্বচ্ছন্দ।”
শুধু দুর্গাই নয়, ইতিমধ্যেই আরও অনেক মূর্তি গড়েছে প্রলয়। ছৌ-এর মুখোশ, ছত্রধারী গণেশ, পাখি, চকের উপর পেঁচা, সিংহ। তিলক মাটির সরস্বতী। কাঁঠাল কাঠের জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। রয়েছে পুডিং দিয়ে তৈরি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মুখ। এখন অবশ্য অন্য কোনও দিকে মন নেই তার। সে ব্যস্ত পুজোর আয়োজনে। প্রতিবারের মতোই মহালয়ার ভোরে মায়ের চক্ষুদান করেছে সে।
এ বার প্রতীক্ষা মহাষষ্ঠীর। গেরুয়া ধুতি-উড়নিতে প্রলয়ই করবে মায়ের বোধন। |