প্রবন্ধ ১...
চিনে শুধু সাহিত্যের নোবেলই গেল না
নোবেল পুরস্কার?’ লন্ডন থেকে ফোনে বললেন অর্থনীতির সাংবাদিক মার্টিন জেকেস, ‘চিন জানিয়ে দিল, আমরা এসে গিয়েছি। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির দুনিয়াতেও আমাদের আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।’ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে মার্টিনের ‘হোয়েন চায়না রুল্স দ্য ওয়র্ল্ড।’ গত সপ্তাহে তাঁর সেই ‘বেস্টসেলার’ ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গেল। নোবেল পেলেন মো ইয়ান, সাহিত্যে রাজত্বের আস্বাদ পেল চিন।
বই লেখার জন্য দশ বছর ধরে হংকং থেকে সাংহাই, বেজিং সর্বত্র চষে বেরিয়েছিলেন মার্টিন। এবং জোর গলায় চিনের উত্থান ঘোষণা করেছিলেন। ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক দেখিয়েছিল, বিশ্বক্রীড়ার আয়োজনেও চিন কম যায় না। আর সাহিত্যসংস্কৃতির ‘সফ্ট পাওয়ার’ বা নম্রশক্তি? রূপোলি পর্দায় ‘ক্রাউচিং টাইগার, হিডেন ড্রাগন’ বা ‘কুংফু পান্ডা’র মতো ছবি। দুনিয়া জুড়ে জেট লি, ঝাং জিজি, জ্যাকি চানের গ্ল্যামার। পাশাপাশি ঝাও জিয়াওগোং বা লিউ জিয়াওডং-এর মতো চিত্রশিল্পীর উত্থান। নিলামসংস্থা সদবি এবং ক্রিস্টি ২০০৬ সালে ১৯ কোটি ডলারের ‘সমসাময়িক এশীয় শিল্পকলা’ বিক্রি করেছিল। এবং তার সিংহভাগই ছিল চিনা শিল্পীদের আঁকা। ‘মো ইয়ানের নোবেল চিনের কাছে নিছক সাহিত্যপুরস্কার নয়। দুনিয়ার কুর্নিশ পাওয়ার স্বীকৃতি,’ বলছিলেন মার্টিন।
শাংহাই। বিশ্বমঞ্চে চিনের আর্থিক প্রতিপত্তির নির্ভুল ছাপ।
কিন্তু কুর্নিশে বিতর্কের ইন্ধন আছে। অনেকে নোবেলজয়ী লেখিকা পার্ল বাকের কথা টানছেন। পার্ল বাক অবশ্য নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৩৮ সালে। তখন ‘কমিউনিস্ট চিন’ দূর অস্ত, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধও শুরু হয়নি। তাঁর সঙ্গে চিনা সাহিত্যেরও কোনও সম্পর্ক নেই, নোবেল-ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে এই পুরস্কার নিতে পেরে আমি গর্বিত।’ সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি প্রথম নোবেলজয়ী মার্কিন লেখিকা!
বিতর্ক অন্য দুটি জায়গায়। ২০০০ সালে ‘সোল মাউন্টেন’ উপন্যাসের দেশত্যাগী লেখক গাও ঝিংজিয়ানের নোবেলপ্রাপ্তি মেনে নেয়নি চিন, ২০১০ সালে মানবাধিকার কর্মী লিউ জিয়াওবোর নোবেল শান্তি পুরস্কারকে স্বীকৃতি দেয়নি । লিউ জিয়াওবোকে কারাগার থেকে মুক্তি না দেওয়া নাকি আসলে নোবেল কমিটির প্রতি চিনের বিরক্তির প্রকাশ কেন বারংবার গাও ঝিংজিয়ান বা লিউ জিয়াওবোর মতো রাষ্ট্রদ্রোহীকে পুরস্কার দেওয়া হবে? মো ইয়ানের পুরস্কার সেই বিরক্তি কাটিয়ে দিয়েছে। জিয়াওবো-কে মুক্তি দেওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে এখন, জানালেন মার্টিন। মো ইয়ানও সেই আবেদন করেছেন। ইয়ান যে পার্টি-নিয়ন্ত্রিত চিনা রাইটার্স অকাদেমির সভাপতি! ‘পাশ্চাত্যের চশমায় চিনকে দেখবেন না। গাও ঝিংজিয়ানও রাইটার্স অকাদেমিতে ছিলেন। চিনে সব লেখক, শিল্পীই অকাদেমির সদস্য’, সতর্ক করলেন মার্টিন।
পাশ্চাত্যের চশমায় চিনকে না দেখার কথা তাঁর বইয়ে বারংবার বলেছেন মার্টিন। পাশ্চাত্যের কাছে প্রগতি = গণতন্ত্র + মুক্ত বাজার। চিন ওই সমীকরণে নেই। তাতে তাদের বৃদ্ধি আটকায়নি। মার্টিন দেখিয়েছিলেন, চিন আদতে অন্ধকারের বাসিন্দা নয়। অষ্টাদশ শতকেও চিন এবং ইংল্যান্ডের জীবন প্রায় এক রকম ছিল। কিন্তু নিউ ক্যাস্ল খনিতে কয়লাপ্রাপ্তি, সমুদ্রবাণিজ্যই তফাত গড়ে দিয়েছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স তখন এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ তৈরি করে সেখানকার জমি, কৃষিজ ও খনিজ সম্পদ দখল করেছিল। অন্য দিকে চিন মঙ্গোলিয়া, কাশগড় ইত্যাদি অঞ্চল দখল করেছিল। সেখানে কর্ষণযোগ্য ভূমির পরিমাণ কম। ফলে, অর্থনীতির বিচারে ইউরোপীয় শক্তির কাছে সে পিছিয়ে পড়ে। কিন্তু চিত্রকলা, স্থাপত্যের ‘সফ্ট পাওয়ার’ তখনও দম হারায়নি। শহরের মাঝে ঝর্না, গাছে সাজানো উদ্যান তৈরির সংস্কৃতি তৎকালীন চিন থেকে বয়ে এনেছিল ইউরোপীয় নাবিকেরা।
বেজিং-এর আজকের প্রতাপের কারণ হিসেবে চিনের আর্থিক সংস্কারকেই প্রাথমিক কৃতিত্ব দিচ্ছেন মার্টিন। দুনিয়ায় কল্কে পেতে গেলে কৃষি থেকে শিল্পে আসতেই হবে।
কিন্তু চিন যে ভাবে কৃষি থেকে শিল্পে আসে, দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রে সেটি সম্ভব নয়। এখানে আদালত থাকে, ইচ্ছুক-অনিচ্ছুকের গেরো থাকে। মার্টিন হাসলেন, ‘ভারতের মুশকিল ওটাই। সবাই আইন বোঝে। এটি ব্রিটিশ শাসনের কুফল।’ গল্পে গল্পে মনে পড়ল মো ইয়ানের ‘চেঞ্জ’ উপন্যাসের কথা। সেখানে নায়ক জানায়, ছেলেবেলায় তাদের গ্রামে ভাল রাস্তা ছিল না। সবচেয়ে চওড়া রাস্তায় পাশাপাশি দুটি গাড়ি যেতে পারত, যুদ্ধের সময় জাপানিরা সেটি তৈরি করেছিল। এক ভূস্বামীর বাড়ি দেখে অবাক হয়েছিল সে। কী বিশাল বাড়ি! এখন চার দিকে শহর, সেই প্রাসাদোপম বাড়িকেও ছোট লাগে। ‘শহর আমার দৃষ্টির বিস্তার ঘটিয়ে দিয়েছে,’ জানায় নায়ক।
চিনের উত্থানের পিছনে শহরের কথাই লিখেছিলেন মার্টিন। তাঁর হিসেব ছিল, সাতের দশকে চিনে মাত্র ১৭ শতাংশ লোক শহরে থাকত। আগামী ২০১৫ সালে সংখ্যাটা বেড়ে প্রায় ৫০ শতাংশে পৌঁছবে। লিখেছিলেন নতুন নগরায়ণের কথা, ‘শুধু গগনচুম্বী অট্টালিকা আর উড়ালপথ দেখে সাংহাইকে নিউ ইয়র্কের প্রতিচ্ছবি ভাবলে ভুল করবেন। পাশ্চাত্যের শহরগুলিতে থাকার জায়গা, স্কুল-কলেজ, অফিসকাছারি, পার্ক আলাদা এলাকায়। কিন্তু চিনে এই রকম এলাকা-বিভাজন নেই। বাসস্থান, অফিসকাছারি সব এক জায়গায়।’
মার্টিনকে বলেছিলাম, ‘আমরা কিন্তু সাংহাই, হংকঙের অত ভক্ত নই। লন্ডন-ই কলকাতার আদর্শ।’ লেখক প্রায় আঁতকে উঠলেন, ‘মাই গুডনেস! লন্ডনের জনসংখ্যা কত? ৮০ লক্ষ। আর কলকাতার জনসংখ্যা তো দেড় কোটির কাছাকাছি। সাংহাই, বেজিং-ই মডেল হওয়া উচিত। আশপাশের গ্রামগুলিতে শিল্প তৈরি, শহর বানানো, রাস্তাঘাট ও পরিকাঠামোর উন্নতি। আপনারা পিছন দিকে চাকা ঘোরাতে চাইছেন।!’
তিন মাস আগের সফরে কলকাতা ছাড়াও দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু ঘুরে গিয়েছিলেন মার্টিন। দুই প্রতিবেশী দেশকে দেখার পর তাঁর মনে হয়েছে, ‘চিন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মার্কিন অর্থনীতিকেও ছাপিয়ে যাবে। চিনের পাশাপাশি দৌড়ানোর স্বপ্ন ভারতের অধরাই থেকে যাবে। ঘুরে দাঁড়াতে গেলে ভারতকে এখনই জোর কদমে আর্থিক সংস্কার চালাতে হবে।’ আর‌্থিক সংস্কারই সব নয়। মার্টিন তাঁর বইয়ে জানিয়েছেন, গত তিন হাজার বছর ধরে চিনের মানচিত্রে কোনও ভাঙন ধরেনি। চৈনিক সভ্যতায় তাই রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে সম্রাটকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি মনে করা হত। আবার ঈশ্বরপ্রেরিত প্রতিনিধি হিসাবে সম্রাটেরও দায়িত্ব ছিল। কনফুসিয়াস বলেছিলেন, দুর্ভিক্ষ বা রাষ্ট্রবিপ্লবে সম্রাট যথাযথ দায়িত্ব না পালন করলে তাঁর ওপর থেকে স্বর্গীয় অনুগ্রহ সরে যাবে। এই দায়িত্ব পালনের কারণে চৈনিক সভ্যতায় সম্রাটের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমলারা। হাজার বছর আগেও চিনে আমলার চাকরির জন্য পরীক্ষা হত, কনফুসিয়াসের নীতি নিয়ে লিখতে হত। জারতন্ত্রের শেষে সোভিয়েত আমলাতন্ত্র সে দেশে নতুন ছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট চিনে নয়।
রাষ্ট্রের প্রতি (এবং স্বাভাবিক ভাবেই, পার্টির প্রতিও) আনুগত্য সে দেশে মজ্জাগত। সে কারণেই মো ইয়ানের নাম নোবেল পুরস্কারের তালিকায় থাকার খবর পেলে আট হাজার চিনা নাগরিক অনলাইন ভোটে জানান, মো-ই এক নম্বরে, কিন্তু ‘সোল মাউন্টেন’-এর লেখক গাও ঝিংজিয়ান ক্ষমা পান না। কারণ, তিনি শুধু সম্রাট তথা কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতাতেই ক্ষান্ত হননি, দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
এই চৈনিক সংস্কৃতির কারণেই মাও-এর মমিদর্শনে আজও, এই বাজার-মোহিত চিনেও, লম্বা লাইন। ‘মাওয়ের নীতিতে আহামরি উন্নয়ন হয়নি ঠিকই, কিন্তু কৃষি এবং ভূমিসংস্কারের বীজটা পোঁতা হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণেই লোকে তাঁকে পিতৃপুরুষের সম্মান দেয়,” বলছিলেন মার্টিন।
আজকের চৈনিক সংস্কৃতি তাই শুধু সাহিত্য পুরস্কার জয়ের রাস্তা দেখায়নি। দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ায় কী ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে হয়! প্রথম ধাপে অর্থনীতি, শিল্পের ‘হার্ড পাওয়ার’ বা উগ্র ক্ষমতা। সেটি পেরিয়ে শিল্পসংস্কৃতির নম্র ক্ষমতা।
মো ইয়ানের নোবেল জয়, অতএব, বিশ্বমঞ্চে ক্ষমতা অর্জনের ছকে চিনের আরও এক কদম এগিয়ে যাওয়া। সাহিত্য? উপলক্ষমাত্র।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.