কোনও বিষয় ‘ক্ষতিকর’ মনে হইলে তাহা বন্ধ করিবার উপায় কী? কাণ্ডজ্ঞান থাকিলে একটিই উত্তর হয় ‘আপত্তিকর’ বিষয়টির বিরুদ্ধে জনচেতনা জাগ্রত করা। অন্তত গণতন্ত্রে সেটাই যথার্থ পদ্ধতি। কিন্তু বাস্তবে প্রায়শ দেখা যায় জনসাধারণের উপর দল বা সংগঠনের সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে চাপাইয়া দেওয়ার তাগিদ। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কফি-বিপণি বন্ধ করা হইতে দেশে খুচরো বিপণনে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ স্তব্ধ করা সর্ব ক্ষেত্রেই জনচেতনা জাগাইবার দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার পরিবর্তে এ ভাবে গা জোয়ারি করিয়া নিজেদের সিদ্ধান্ত জনগণকে গলাধঃকরণ করিতে বাধ্য করার নিদর্শন চোখে পড়িতেছে। প্রেসিডেন্সির ছাত্র ইউনিয়ন ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট কনসলিডেশন’ যাহা করিয়াছে, খুচরো বিপণনে বিদেশি লগ্নির বিরোধিতায় সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটও সেই একই পদ্ধতি অবলম্বনের ডাক দিয়াছেন। পদ্ধতিটি প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কিংবা ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’।
সিদ্ধান্তটি গণতান্ত্রিক তো নহেই, প্রায়শ এই ধরনের সিদ্ধান্তের সহিত জনসাধারণের অভিজ্ঞতা ও অভিপ্রায়ের প্রত্যক্ষ বিরোধও থাকে। খুচরো বিপণনে দেশীয় সুপার-মার্কেট-এর ক্রিয়াকলাপ এবং কৃষিপণ্যের উৎপাদকদের তাহাতে উপকৃত হওয়ার অভিজ্ঞতার যেমন আছে। কৃষিজীবীরা ‘ফড়িয়া’দের অত্যাচার হইতে মুক্ত হইতে এই সব সুপার-মার্কেটকে উদ্বাহু হইয়া স্বাগত জানাইতেছেন। কিন্তু বামপন্থীরা স্বভাবতই কৃষি-উৎপাদকদের সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার মঞ্জুর করিতে দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁহাদের ভয়, নিজেদের ভালমন্দ বিষয়ে সিদ্ধান্ত লওয়ার অধিকারী হইলে জনসাধারণের কাছে তাঁহারা অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়িবেন। এ ভাবেই বামপন্থীরা জনসাধারণকে পরিচালনা করিতে অভ্যস্ত। ইদানীং এ দেশে তাঁহাদের ভয় আরও বাড়িয়াছে অন্য কারণে।
কারণটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এই প্রশ্নে ইউপিএ সরকারের শরিকানাই ত্যাগ করিয়াছেন। বলিতে গেলে, বামপন্থীদের, বিশেষত সিপিআইএমের আজেন্ডাই কার্যত ‘ছিনতাই’ হইয়া গিয়াছে। সিপিআইএম নেতারা ইহাকে ‘ছদ্ম বামপন্থা’ আখ্যা দিয়াছেন। তথাপি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতায় দেশব্যাপী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠস্বরই মুখরতর। সিপিআইএমের ন্যায় যে দল নিজের হারানো জমি উদ্ধার করিতে ব্যগ্র, তাহার নেতাদের কাছে ইহা অশনি-সঙ্কেত। তাই বিরোধিতার সুর চড়াইয়া নিজেদের ‘আগ-মার্কা’ বামপন্থী প্রতিপন্ন করিতেই প্রকাশ কারাটের ডিরেক্ট অ্যাকশন-এর ডাক। এই ‘অ্যাকশন’ হিংসায় প্ররোচনা কিনা, সে প্রশ্নের জবাবে অবশ্য কারাট তৎক্ষণাৎ সত্যাগ্রহের মতো নিরামিষ গাঁধীবাদী আন্দোলনের কথা বলিয়াছেন। অণ্ণা হজারে কিংবা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গাঁধীবাদী আন্দোলনও যে বামপন্থাকে রাজনৈতিক ভাবে বহুলাংশে অবান্তর করিতেছে, এই উপলব্ধিও সম্ভবত কারাটের ‘রণং দেহি’ অবস্থানের পিছনে। সিপিআইএম সহ বামপন্থীরা যে ভারতীয় রাজনীতিতে হৃত প্রাসঙ্গিকতা পুনরুদ্ধারে মরিয়া, তাহাতে সন্দেহ নাই। |