সম্পাদকীয় ১...
অপরাধের মুক্ত বাজার
বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্ষণের প্রতিবাদ করিতেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্ষণের সংবাদের প্রতিবাদ করিয়া থাকেন। ইহা পুরাতন সংবাদ। নূতন চমক তাঁহার সমাজবীক্ষায়। আজকাল সমাজ যে পুরুষ-নারীর মেলামেশার প্রতি বড়ই উদার মনোভাব দেখাইতেছে, এমনকী পরস্পর হাত ধরিয়া ঘুরিলেও অভিভাবকরা তাহাদের কষিয়া বকিতেছেন না, এমন ‘উন্মুক্ত’ সমাজব্যবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী বড়ই বিরক্ত। তাঁহার ক্ষুব্ধ বক্তব্য, সমাজ যেন মুক্ত বাজারের ন্যায় সঙ্গী নির্বাচনের অবাধ স্বাধীনতা দিতেছে। প্রকাশ্য সভায় তাঁহার এই উক্তি স্পষ্ট করিয়া দিল, প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষকেও ‘নাবালক’ বলিয়া দেখিয়া তাহাদের উপর সামাজিক বিধিনিষেধের কঠোর নিয়ন্ত্রণ চাপানোয় তিনি বিশ্বাসী। যাহাদের রাজনৈতিক নির্বাচনের অধিকারের বলে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হইয়াছেন, তাহাদের প্রণয়সঙ্গী নিবার্চনের অধিকার দিতে তিনি রাজি নহেন। কিন্তু এহ বাহ্য। মুখ্যমন্ত্রী যে ব্যক্তির স্বাধীনতায় কত দূর আস্থাবান, তাহা তাঁহার মন্ত্রিসভার দিকে তাকাইলেই স্পষ্ট হয়। সে বিষয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু সঙ্গী নির্বাচনের এবং নারী-পুরুষের খোলাখুলি মেলামেশার বিরুদ্ধে তাঁহার এই বক্তব্যকে লঘু ভাবে গ্রহণ করা চলে না এই কারণে যে, তিনি ধর্ষণের প্রসঙ্গে এই কথাটি বলিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গকে ‘ধর্ষণভূমি’ বলিয়া দেখানো হইতেছে, ইহাই তাঁহার ক্ষোভ। ইহার ফলে নারীর সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতার সহিত তাহার যৌন-নির্যাতনের একটি যোগসূত্র রচিত হইতেছে, যাহা পশ্চিমবঙ্গকে বসাইয়া দিয়াছে হরিয়ানার পাশে। কোনও তরুণীর সামাজিক স্বাধীনতাই তাহার সামাজিক বিপন্নতার কারণ, এমন ভয়ানক মন্তব্য কেহ প্রকাশ্য সভায় করিতে পারেন, তাহা সহসা বিশ্বাস হইতে চাহে না।
মমতা রাজ্যের রাজনীতি, কেন্দ্রীয় রাজনীতি রপ্ত করিয়াছেন। তিনি লিঙ্গ রাজনীতির মৌলিক কথাটুকু কি বুঝিতে পারেন নাই? মেয়েদের সুরক্ষার উপায় তাহাদের উপর নিয়ন্ত্রণ নহে, অপরাধীদের উপর নিয়ন্ত্রণ। মেয়েদের উপর অভিভাবকত্ব ফলাইলে তাহাদের আরও সমস্যায় ফেলা হয়, কারণ লক্ষ্মণরেখা পার হইবার দায় তাহাদের উপরেই স্বচ্ছন্দে চাপাইয়া দেওয়া যায়। মুখ্যমন্ত্রীর অনুগামীরা এ যাবৎ তাহাই করিয়াছেন। কেহ প্রশ্ন করিয়াছেন, ধর্ষিতা মহিলা অধিক রাতে কেন বাড়ির বাহিরে ছিলেন, কেহ বলিয়াছেন মেয়েরা কেন আধুনিক পোশাক পরিয়া বাহির হয়। যে সকল ‘অভিভাবক’ মেয়েদের পায়ে শিকল পরাইয়া তাহাদের ‘সুরক্ষিত’ রাখিতে চাহে, এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রী তাহাদের নেতৃত্ব দিতেছেন, ইহা বড়ই আক্ষেপের বিষয়।
আশঙ্কার বিষয় এই যে, এই মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্যটি নারীদের উপর অপরাধের সংখ্যায় সকল রাজ্যের শীর্ষে। ২০১১ সালে অপরাধ বিষয়ক জাতীয় পরিসংখ্যান অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গে ২৯,১৩৩টি অপরাধ ঘটিয়াছে মহিলাদের উপর, যাহার মধ্যে রহিয়াছে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন, অপহরণ, প্রভৃতি। হরিয়ানা ও দিল্লি অপেক্ষাও পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণের সংখ্যা অধিক। যৌন হয়রানি এবং শ্লীলতাহানিতে এ রাজ্য জাতীয় হার অতিক্রম করিয়াছে। ইহা অকস্মাৎ ঘটে নাই, গত আট বৎসর ধরিয়াই পশ্চিমবঙ্গ মহিলাদের উপর অপরাধের শীর্ষে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ নারী নির্যাতনকারীদেরই উন্মুক্ত বাজার। অপরাধীরা ঘরে বাহিরে ইচ্ছা মতো শিকার নির্বাচন করিতে পারে। রাজ্যে প্রায় অর্ধেক পরিবারে প্রাপ্তবয়স্ক হইবার পূর্বে মেয়েদের বিবাহ দেওয়া হয়, যাহাতে সে স্বয়ং সঙ্গী নির্বাচন করিতে না পারে। অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মেয়েদের সম্মুখে পুরুষসঙ্গীর ‘মুক্ত বাজার’ লইয়া উদ্বিগ্ন। মেয়েদের উপর অপরাধকে অধিক গুরুত্ব দিয়া দেখাইবার জন্য তিনি সংবাদমাধ্যমকে দোষারোপ করিয়াছেন। অথচ প্রয়োজন ছিল ঠিক বিপরীত। মেয়েদের প্রতি অপরাধের ঘটনাগুলিকে গুরুত্ব দিবার নির্দেশই তাঁহার কাছে প্রত্যাশিত ছিল। রাজ্যের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করিতে ধর্ষণের ঘটনাকে অন্তরালে রাখিতে হইবে, এই নিপাট পুরুষতান্ত্রিক দাবি করিতে কোনও পুরুষ মুখ্যমন্ত্রী হয়তো সাহস করিতেন না। মহিলা হইবার সুযোগ গ্রহণ করিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.