কার্তিক-গণেশের দু’বেলা পড়তে বসার পাট চুকে গিয়েছে। হবে না-ই বা কেন? মামার বাড়ি যাওয়ার আগে আর মাত্র ক’টা দিন। চটপট বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে ফেলতে হবে। মোটে দিন চারেক থাকা। কিন্তু যাওয়ার জায়গা অনেক। কাজেই জমকালো পোশাক চাই। থিমপুজোর জন্য ডিজাইনার পোশাক থেকে, ডাকের সাজের জন্য সাবেক ধুতি-পাঞ্জাবি! হাঁস, ইঁদুর, ময়ূর, পেঁচাদের আগে থেকে খবর দেওয়া আছে। তারাও সময়মতো এসে পড়বে। তার পরে লোটাকম্বল গুছিয়ে লক্ষ্মী-সরস্বতীর সাজগোজের হাজারো জিনিসপত্র সামলে ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে বেরিয়ে পড়া! ওহো! চেঁচিয়ে মায়ের নাম বললে তো আবার কানমলা খেতে হবে!
কৈলাস থেকে কার্তিক-গণেশ আসছে কলকাতায়। সপ্তমীটা রবিবার পড়েছে। সে দিন আবার কোথায় কী বন্ধ থাকে, তাই ষষ্ঠীতেই পৌঁছতে হবে। সপ্তমীতে ‘ট্র্যাডিশনাল’ সাজেরই ইচ্ছে আছে। প্রথমে তাই ‘দমদম পার্ক সর্বজনীন দুর্গোৎসব’। সেখানে এ বার আটচালায় ঠাকুর। মণ্ডপসাজের উপকরণে থাকবে কুলো, কুনকে ও কড়ি। কাপড়ের বদলে ব্যবহার হবে বাঁশের ফালি। ‘দমদম সিদ্ধেশ্বরী গার্ডেন্স’-এ আবাসিকদের পুজো আর ‘শ্যামবাজার উত্তর প্রান্তিক সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’-র পুজোতেও বজায় থাকবে সাবেকিয়ানা।
অষ্টমী থেকে শুরু হবে ‘ঝিনচ্যাক’ ড্রেস। ১০২তম বর্ষে ‘শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’ অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট নিয়ে কাজ করেছে। জ্যামিতিক আকারে ময়ূরের পেখমের মতো হবে মণ্ডপ। প্রবেশপথটা ফুলের আদলে। পশুপাখি, লতা, ফুলের মডেল। সব মিলিয়ে দারুণ রঙিন ব্যাপার! কাজেই অষ্টমীতে একটু পশ্চিমী ডিজাইনার পোশাক বার করতে হবে। নারদমামা জানুয়ারিতে ব্যাঙ্কক থেকে দারুণ জামা এনেছিল। সেগুলো তো আছেই।
অষ্টমীতে খুব হুড়োহুড়ি। লিস্টে রয়েছে ‘হাতিবাগান সর্বজনীন’, ‘কাশী বোস লেন’ বাগুইআটির ‘উদয়ন সঙ্ঘ’, সুরেন সরকার রোডের ‘নব জাগ্রত সঙ্ঘ’। হাতিবাগান সর্বজনীনের এ বার ৭৮ বছর। ‘আলোর খোঁজে’ থিম বোঝাতে কাচের মোল্ডিংয়ে ফোটানো হবে জীবজগৎ সৃষ্টির মূলের পাঁচ শক্তি ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। গাছপালা, প্রজাপতি, মাছের মাধ্যমে বোঝানো হবে জীবজগৎকে। থিমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিমা। দেবীর আট হাতে থাকবে প্রদীপ, দু’হাতে পৃথিবী। উফ্, মা-কে যা দেখাবে না! খুশিতে ডগমগ লক্ষ্মী-সরস্বতী। কাশী বোস লেনের পুজোর এ বার ৭৫ বছর। সেখানের থিম সমুদ্রের জলস্তর থেকে পৃথিবী রক্ষা করার বার্তা। নানা ধরনের আলোর কারিকুরিতে চার দিক ধাঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। ওই পুজো না দেখলে রাত জাগাটা সার্থক হবে না। তবে, ‘মা’ সেখানে কিন্তু সাবেক রূপেই থাকছে। ‘উদয়ন সঙ্ঘ’-এর থিম ‘পুরাণকল্পে নারী’। মণ্ডপ জুড়ে সীতা, দ্রৌপদী, রাধা, শকুন্তলার গল্প। ‘নব জাগ্রত সঙ্ঘ’-এর থিম আলাদিনের বাড়ি। আরব্যরজনীর পরিবেশে পেল্লায় কেল্লার আদলে হবে মণ্ডপ।
দশমীতে বিশেষ কিছু করা যায় না। সকলেরই মন খুব খারাপ থাকে। তাই নবমীর সাজটা হবে অন্য রকম, ‘মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ’। কৃষ্ণপুরের ‘দক্ষিণ রবীন্দ্রপল্লি সর্বজনীন’-এর থিম ‘দশাবতার তাস’। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে মল্লরাজাদের আমলে নাকি এর প্রবর্তন হয়। রবীন্দ্রপল্লি ফিরিয়ে আনছে হারিয়ে যাওয়া এই শিল্পকে। ‘মুকুন্দপুর সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’র থিম আবার ‘অন্য দুগ্গা’। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আজকের দুর্গাদের স্বয়ংসম্পূর্ণা হওয়ার গল্প। মণ্ডপসজ্জার উপকরণে থাকবে বাঁশ, কাঠ, বাটাম, প্লাই। অ্যাক্রিলিক পাতে এঁকে, প্লাইয়ের জাফরিতে নানা কারুকাজে ফুটে উঠবে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মহিলাদের জীবনচর্যা। আয়নায় প্রতিফলিত হবে প্রতিমা। দড়ির রেখাচিত্রে, জ্যামিতিক নকশায় তৈরি হবে এক অভিনব দৃশ্যময়তা। এই দু’টো পুজোয় নতুন-পুরনো মিশিয়ে হবে সাজের ফিউশন।
শুধু কি কলকাতাই সাজবে? কৈলাসের কি সাধ-আহ্লাদ থাকতে নেই? পুজোর দিনগুলোয় টিপ-টপ থাকার জন্য তাই জোরদার ঘষা-মাজা চালাচ্ছে লক্ষ্মী-সরস্বতী। আর কার্তিক-গণেশ এখনও নেহাৎই খুদে। ওরা শুধু দিন গুনছে এক, দুই, তিন... |