ঝলমলে নীল আকাশ আর সোনা রোদের হাত ধরে পুজোর আমেজটা এলে মনটাও একটু ছুটি চায়। শহুরে জীবনের ব্যস্ততার মধ্যেই খুঁজে নেয় সবুজ কোনও প্রান্তর। সেখানে সে নেয় কাশফুলের ঘ্রাণ, শরতের ভোরে হিমের পরশ। আর সন্ধ্যায় ঠাকুরদালানে বসে একদৃষ্টে দেখে, ধীরে ধীরে সালঙ্কারা হচ্ছেন দশভুজা। পুজোর চার দিন শহরের চার দেওয়ালের মধ্যে এ ভাবেই সেজে ওঠে একটুকরো শস্যশ্যামলা গ্রামবাংলা। বিকশিত হয় মানবসভ্যতা। তবুও কালের অনিবার্য নিয়মে সৃষ্টির পরে আসে ধ্বংস। তার শক্তিতে কলুষিত হয় বিশ্ব। তখনই দেখা দেন মহামায়া। তাঁর ছোয়ায় অশুভ শক্তি পরাভূত হয়, পৃথিবী আবার হয়ে ওঠে নান্দনিক। শোনা যায় সৃষ্টির জয়গান। সেই শুভ শক্তিরই আরাধনা এ বার বড়িশা উদয়নপল্লিতে। এই আনন্দযজ্ঞে সবার মধুর আমন্ত্রণ।
উৎসবের আনন্দের পাশাপাশি যখন দেখা দেয় ধর্মীয় সংঘাত, মানুষের রক্তে রাঙে মাটি, তখন চারপাশের বাতাসও হয়ে ওঠে বিষাক্ত। একমাত্র সুস্থ মানসিকতাই পারে সেই বিষ দূর করে জীবনের ছন্দ ফিরিয়ে আনতে। সবুজায়ন সেই মানসিকতারই এক প্রকাশ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে উষ্ণায়ন আজ ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। প্রাচীনকালে গাছ পূজিত হত মা রূপে। ক্রমে ক্রমে দুর্গা এবং বৃক্ষদেবতা হয়ে উঠলেন পরিপূরক। তারই এক খণ্ডচিত্র শীতলাতলা কিশোর সঙ্ঘে। মূল মণ্ডপে প্রকৃতি, গাছ ও মানুষের মেলবন্ধনের কাহিনি। প্রবেশপথে ম্যুরালের মাধ্যমে শব্দদূষণ, জলদূষণও বায়ুদূষণের কুপ্রভাব। একটি গাছ লাগালে কী ভাবে সতেজ হয়ে ওঠে ধরণী, তারই বার্তা দেবে এই পুজো।
সুর, তাল, ছন্দ এই তিনের মিলনে পূর্ণতা পায় শিল্পকলা। পুরাণে আছে, স্বয়ং শিব তাঁর নটরাজ রূপে নৃত্যশৈলীতে মুগ্ধ করেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রকে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যে ধারা, তারও মূলে সঙ্গীত ও নৃত্যকলার সেই উৎকর্ষ। সুবর্ণজয়ন্তী পার করে বড়িশা নেতাজি সঙ্ঘ তাঁদের পুজোয় ফিরিয়ে আনছেন সুরের সেই মূর্ছনা। খড়, হোগলাপাতা আর রঙিন কাপড়ে সাজবে মণ্ডপ। ভিতরে দেখা যাবে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সনাতন নৃত্যশৈলী এবং বাদ্যযন্ত্র। দেবী দুর্গার সামনেও থাকবে এক নৃত্যাঙ্গন।
মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার দু’টি চোখ। বিপুলা এ পৃথিবীর সঙ্গে শৈশবে তার পরিচয় হয় দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমেই। সেই ভাবনা থেকেই শকুন্তলা পার্ক এভারগ্রিনের এ বারের ভাবনা ‘দৃষ্টি’। অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে আলোকোজ্জ্বল চোখে তাঁরা সামিল মহামায়ার আবাহনে। কিন্তু জীবনে চলার পথে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায় অনেকের। সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে শুরু হোক মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার, এই পুজোর উদ্যোক্তারা দেবেন সেই বার্তাই।
পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে শিল্পী হেরম্ব দাস পাটকাঠি, নারকেল দড়ি, বাঁশের কারুকাজে সাজিয়ে তুলবেন বড়িশা সর্বজনীনের পুজোমণ্ডপ। তাঁদের এ বারের ভাবনা ‘পাটকাঠির টানে, মা মোদের অঙ্গনে’। পাটজাত শিল্পকে নতুন রূপ দেবেন উদ্যোক্তারা। সঙ্গে বাড়তি পাওনা জঙ্গলমহলের লোকসংস্কৃতি আর ধামসা-মাদলের তালে পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্য। বড়িশা মিলনী সঙ্ঘে দুর্গার অধিষ্ঠান কাচের মণ্ডপে। অসুরনাশিনী দশভূজা সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রক্ষা করবেন মানবজাতিকে।
বেহালার প্রগতি সঙ্ঘ সর্বজনীন দেবী দুর্গাকে সাজাবে হিরে-চুমকিতে। জরির কাজে, নানা রঙের বর্ণালীতে উমার এখানে অন্য রূপ। রং-বেরঙের পাথরের চকমকিতে, মানানসই আলোয় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে চার দিন কাটাবেন তিনি। ৫৩তম বর্ষে বেহালার পল্লি উন্নয়ন সমিতিতে আবার দেখা যাবে দুর্গার ২১ রূপ। মণ্ডপসজ্জা এবং আলোয় অন্য এক পরিবেশ এখানে। বেহালারই আর এক পুজো, ব্রাহ্মসমাজ পল্লি দুর্গাপূজা কমিটি এ বছর শ্রদ্ধা জানাবে স্বামী বিবেকানন্দকে, তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’। সেই ভাবনা থেকেই এই পুজোর থিম ‘স্বপ্ন যখন আকাশছোঁয়া’। স্বপ্ন দেখতে কে না ভালবাসে? আর দুর্গার আশীর্বাদে সার্থক রূপ পায় সেই স্বপ্ন।
সবেদাবাগান ক্লাব এ বছর হেঁটেছে একটু অন্য পথে। খেলার জগতে আজ তাস অত্যন্ত সুপরিচিত। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টেছে এই খেলার নিয়মকানুন, তারতম্য ঘটেছে তার সংখ্যাতেও। শিল্পী জয় ঘোষের হাতে প্রায় এক হাজার তাসে সেজে উঠবে মণ্ডপ। তাসের ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে জানতে হলে আসতে হবে এখানে। ৪৭তম বর্ষে হরিদেবপুরের বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের এ বারের ভাবনা ‘শক্তির আলোয়’। বিভিন্ন পেন্টিং দিয়ে মণ্ডপসজ্জা। মানানসই সাবেক প্রতিমা। গড়িয়ার কামডহরি নাটেরবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসবেও পুজোর চার দিন জমে উঠবে আনন্দমেলা। এই পুজো এ বার পা দিল ৫৬ বছরে।
এ কলকাতার মধ্যেই যে আছে আর একটা কলকাতা, সে কথা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। আলোর রোশনাইয়ের পাশাপাশি ‘অন্ধকার’ সেই কলকাতায় হাত-ধরাধরি করে থাকে দারিদ্র আর না-পাওয়ার যন্ত্রণা। আসন্ন শারদোৎসবে বড়িশা ইয়ুথ ক্লাব ফুটিয়ে তুলবে এই অন্ত্যজদের দেবী-বন্দনাকে। তাঁদের রোজকার জীবনে ব্যবহৃত নানা জিনিস দিয়ে তৈরি হবে স্বপ্নপুরী। উৎসবের দিনগুলিতে তাঁদের জীবনেও পড়বে ‘আগমনী’র আলো। |