কাঠা ভরা ধানের উপর চেলি পেতে, সিঁদুর লেপে তৈরি হয় গৃহলক্ষ্মীর আসন। সপ্তমীতে পুজো শুরুর আগেই সাজিয়ে গুছিয়ে বাড়ির এই মা লক্ষ্মীকে সাজার মায়ের মন্দিরে পাঠিয়ে দেন ভট্টাচার্য পরিবারের লোকজন। তার পরেই শুরু হয় কালনার ধাত্রীগ্রাম এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাচীন দুর্গাপুজো। বাসিন্দারা জানান, দীর্ঘ দিনের পুরনো এই প্রথা।
কালনা মহকুমার প্রাচীন জনপদ ধাত্রীগ্রাম। বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার লোকজনের। বেশির ভাগই পেশায় তাঁতি। বারোয়ারি ও বাড়ির পুজো মিলিয়ে প্রায় ২০টি পুজো হয়। কিন্তু সাজার মায়ের পুজো নিয়েই বাসিন্দাদের উৎসাহ সব চেয়ে বেশি। পুজোর চার দিন তো বটেই, বিশেষ করে অষ্টমী ও নবমী পুজোর দিন সারা এলাকা ভেঙে পড়ে এই পুজোর প্রাঙ্গনে। |
এলাকার বাসিন্দারা জানান, তিনশো বছরেরও বেশি আগে নদিয়ার ব্রহ্মশাসন নামে এক গ্রাম থেকে সপরিবারে ধাত্রীগ্রাম এসেছিলেন এক পণ্ডিত। নাম ছিল রামচন্দ্র তর্কসিদ্ধান্ত। পাকাপাকি বাস শুরুর পরে এলাকায় একটি টোল খুলে বিদ্যাচর্চা শুরু করেন তিনি। তাঁর পরিবারের সদস্যেরা এলাকায় পরিচিত হন চন্দ্রপতি গোষ্ঠী নামে। তাঁরাই প্রথম এই পুজো করেছিলেন। গোষ্ঠীসদস্যেরা জানালেন, গোষ্ঠীর উদ্যোগে পুজো, তাই দুর্গা এখানে ‘সাজার মা’ নামেই পরিচিত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ওই গোষ্ঠীর অনেকেই অন্যত্র চলে গিয়েছেন। যাঁরা থেকে গিয়েছেন, পুজো করার মতো বিপুল আর্থিক ক্ষমতা তাঁদের কমে এসেছে। তাই বাধ্য হয়েই গোষ্ঠীর হাত ডিঙিয়ে এই পুজো হয়ে উঠেছে একেবারে সর্বজনীন, গ্রামবাসীদের জন্য। তাঁরাই দায়িত্ব নিয়েছেন পুজোর। তাঁরা জানালেন, পুজো পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি ট্রাস্টি বোর্ড। বাজেট প্রায় ৫০ হাজার টাকা। বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলে জোগাড় হয় সেই টাকা। চন্দ্রপতি গোষ্ঠীর নবম পুরুষ তথা ট্রাস্টি বোর্ডের সম্পাদক উমানাথ ভট্টাচার্য বলেন, “সপ্তমীর দিন গৃহলক্ষ্মী নিয়ে যাওয়া-সহ সকল বিধিই নিয়ম মেনে পালন করা হয়।”
গ্রামবাসীরা জানান, শুরুতে সাজার মায়ের মন্দির ছিল তাল পাতায় তৈরি। এখন অনেকটা এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে কংক্রিটের মন্দির। পুজোর জন্য মন্দিরের সামনে বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি মণ্ডপ। পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। আখ, কলা, ছাঁচি কুমড়ো বলি দেওয়া হয়। অষ্টমীর দিন হাজার খানেকেরও বেশি মাটির মালসাতে ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। চন্দ্রপতি গোষ্ঠীর সদস্যেরা জানান, এক সময়ে নবমীতে কুমারী পুজোর চল ছিল। কিন্তু একবার এক কুমারী নিজের মুখে পুজোয় তার অসন্তুষ্টির কথা জানানোর পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় কুমারী পুজো। আগে পুজোর সময়ে যাত্রার চল ছিল। কিন্তু এখন তার দিন গিয়েছে।
কিন্তু জৌলুস কমলেও এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুরনো দিনের গন্ধ। তাই সাজার মায়ের পুজোর কথা উঠলেই স্মৃতিমেদুর হয়ে যান গ্রামবাসীরা। তেমনই এক জন, কমল দাস বলেন, “তিন দশক আগে এটাই ছিল এলাকার একমাত্র পুজো। জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামোয় মাটির প্রলেপ পড়া মাত্রই যেন পুজোর খবর ছড়িয়ে যেত গ্রামে। সে দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত দিন গোনা। সে সব কথা মনে পড়ে। এখনও অষ্টমীর সন্ধিপুজো বা নবমী পুজো, শত ব্যস্ততাতেও ঘরে থাকতে পারেন না গ্রামের কেউ।” |