বিগত চার দশকে টানাপোড়েন হয়েছে ছ’বার। কলকাতার বেলগাছিয়া আর কল্যাণীর মোহনপুরের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালে বেলগাছিয়ায় ৩৬ একর জমিতে থিতু হয়ে বসে রাজ্যের একমাত্র প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়। এখন আবার তাকে মোহনপুরেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। অবশ্য পুরো বিশ্ববিদ্যালয় নয়, শুধু স্নাতক স্তরের পঠনপাঠনের ব্যবস্থা সরানো হচ্ছে মোহনপুরে। স্নাতকোত্তর বিভাগ এবং গবেষণা চলবে বেলগাছিয়াতেই।
প্রায় ১৭ বছর পরে ফের এই ঠাঁইবদলের সিদ্ধান্তে আপত্তি আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির শিক্ষকের। তাঁদের অভিযোগ, খাস কলকাতায় এত বড় জমি খালি করতেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশনের কাছে এক লপ্তে এতখানি জমিতে সরকারের অন্য কোনও পরিকল্পনা রয়েছে। মুশকিল আসানের আর্জি জানিয়ে আচার্য-রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনকে চিঠি লিখেছেন তাঁরা।
মেডিক্যাল কাউন্সিল যেমন মেডিক্যাল কলেজগুলিতে পড়াশোনার পরিকাঠামোর উপরে নজর রাখে, তেমনই প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জাতীয় স্তরে রয়েছে ভেটেরিনারি কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (ভিসিআই)। ২০১১ সালে ভিসিআই পরিদর্শন করে পশু-খামার, বড় পশু-হাসপাতাল এবং পশুদের ময়না-তদন্তের সুবন্দোবস্ত করার সুপারিশ করে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, পশু-হাসপাতালের জন্য রাজ্য সরকার প্রায় ১০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছিল। তার মধ্যে সওয়া এক কোটি টাকা খরচ করে পাঁচতলা হাসপাতাল ভবনের ভিত তৈরির কাজ এগিয়েছে। তার পরেই আচমকা বন্ধ হয়ে যায় সেই কাজ। পশু-খামার তৈরির টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে পূর্ত দফতরকে দেওয়া হয়েছে। সেই কাজ প্রায় শেষের পথে। ময়না-তদন্তের পরিকাঠামোর কাজ অবশ্য এখনও শুরু হয়নি। এই অবস্থায় সরকার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পড়াশোনা সরিয়ে কল্যাণীর মোহনপুরে নিয়ে যেতে চাইছে।
কেন? রাজ্য সরকারের বক্তব্য, কলকাতার বুকে গরু-মোষ রাখার লাইসেন্স আর দেওয়া হয় না। তাই বেলগাছিয়ার পশু-হাসপাতালে কেউ আর অসুস্থ গরু-ছাগলের চিকিৎসার জন্য যান না। ফলে চিকিৎসার কাজ হাতেকলমে শেখার ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। সরকারি সূত্রের খবর, ভিসিআই-এর পরামর্শ অনুসারে গরু-ছাগলের খামার গড়তে যতটা জমি দরকার, বেলগাছিয়ায় তা নেই। মোহনপুরে রয়েছে। সেই কারণেই এই সিদ্ধান্ত।
বেলগাছিয়ার জমি অন্য কাজে ব্যবহারের অভিযোগও উড়িয়ে দিয়েছে সরকার। তাদের বক্তব্য, বেলগাছিয়ায় স্নাতকোত্তর পড়াশোনা এবং গবেষণার কাজ তো চলবেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই জমি অন্য কাজে ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না।
ঠাঁইবদলের সরকারি সিদ্ধান্তে চিন্তায় পড়েছেন শিক্ষক ও পড়ুয়ারা। স্নাতক স্তরে প্রায় ৩০০ ছাত্রছাত্রী, ৬৭ জন শিক্ষক। তাঁদের বক্তব্য, যাতায়াতের দিক থেকে মোহনপুর মোটেই সুবিধাজনক নয়। সেই জন্যই অতীতে বারবার সেখানে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে বেলগাছিয়ায়। শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা স্নাতক, স্নাতকোত্তর দুই স্তরেই পড়ান, বেশি অসুবিধায় পড়তে হবে তাঁদেরই।
শিক্ষকদের দাবি, গত বছর বেলগাছিয়া ক্যাম্পাস পরিদর্শন করে কিছু পরিকাঠামো দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছিল ভিসিআই। মোহনপুরে সেই পরিকাঠামো নেই। বেলগাছিয়ায় পড়ুয়াদের পড়াশোনার সুবিধার জন্য গরু-মোষ রাখার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়কে। কোনও অজানা কারণে সম্প্রতি লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে।
রাজ্যের প্রাণিসম্পদ বিকাশ মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে চিকিৎসকেরা যাতে গ্রামে গ্রামে গরু-মোষ, ছাগল-মুরগির চিকিৎসা করেন, সেটাই আমাদের উদ্দেশ্য। বেলগাছিয়ায় তাঁরা তো কেবল কুকুর-বেড়ালের চিকিৎসা করা শিখছেন।” সরকারের দাবি, ভিসিআই যে-পরিকাঠামোর কথা বলেছে, তা পাওয়া যাবে মোহনপুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী বলেন, “মোহনপুরেও কিছু পরিকাঠামো রয়েছে। মন্ত্রী সেগুলি মেরামত করে দেবেন বলেছেন।” |