বাদুড়ের ডানায় রাষ্ট্রপুঞ্জে পাড়ি দিচ্ছে পাটুলি।
মধ্যগ্রাম চৌমাথা থেকে বাদু-মুখী রাস্তায় কিলোমিটার তিনেক ভাঙলে হুমাইপুর মোড়। রাস্তার এক পাশে হলুদ রঙচটা টিনের বোর্ড—‘ওরা গ্রামেরই একজন। ওদের বাঁচতে দিন।’ তোবড়ানো বোর্ডের নীচে তির চিহ্নে দিক নির্দেশ, পাটুলি-বাদুড়তলা।
প্রশস্ত এক বট আর তাকে ঘিরে ছড়ানো ছিটানো কয়েকটি চালতা, আম, জামরুল গাছ। ঘন ডালপালার আড়ালে কাতারে কাতারে নত মুখ ঝুলে রয়েছে তারা। সমাজে চরম অনাদৃত এক প্রাণী, বাদুড় (গোল্ডেন ফ্রুট ব্যাট)। সংস্কার কিংবা আতঙ্কে, যাদের এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্থ সাধারণ, সেই বাদুড়ে মন মজিয়ে মধ্যমগ্রাম পুরসভার প্রান্তিক এলাকাটি এখন রাষ্ট্রপুঞ্জের নেকনজরে।
পাটুলি জানে, ডাল আঁকড়ে ঝুলে থাকা ওই বাদুড়কুলের কারা চালতা গাছের বাসিন্দা। কাদের ঠিকানা পাশের জামরুল। শেষ বিকেলে কে কোন দিকে উড়ে যায় কিংবা রাতের কোন প্রহরে চেনা বটের ঠিকানায় ফিরে আসে তারা। পাটুলি জানে, দুপুর ওদের ‘বিশ্রামের সময়’, বাদুড়তলা তখন চিত্রবৎ চুপ।
গভীর প্রত্যয়ে গ্রামের জুম্মান আলি চিনিয়ে দেন, “জামরুলের বাসিন্দা যারা, দেখবেন, বিকেলে তারা উড়ে যাচ্ছে আবদালপুরের জলার দিকে। আর ওই যে, বটের মগ ডালে যারা ঝুলছে, সন্ধের মুখে ওরা পাড়ি দেবে আবাদি মাঠের পোকামাকড়ের খোঁজে।” হ্যাঁ, বাদুড়তলা এমনই, খুঁটিয়ে জানে তাদের ‘পড়শি’দের নাড়ি নক্ষত্র।
২০১২ সাল, আন্তর্জাতিক বাদুড়-বর্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। পাটুলির প্রগাঢ় বাদুড়-প্রীতির জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম সংক্ষেপে ইউনেপ, তাই অখ্যাত ওই গ্রামের দুই বাদুড়প্রেমীকে কেনিয়ার নাইভাসা শহরে আন্তর্জাতিক বাদুড়-সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। |
বাদুড় বোঝাই বটগাছ। পাটুলিতে দেবস্মিতা চক্রবর্তীর তোলা ছবি। |
আটপৌরে পাটুলির সে ব্যাপারে বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই। জুম্মান বলেন, “বাদুড়গুলো বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে এ গাঁয়ে আমাদের প্রতিবেশী। তাদের রক্ষা করার জন্য বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে ঢাকঢোল পেটানোর কী আছে বলুন দেখি!”
ইউনেপ কর্তাদের অবশ্য পাটুলির বাসিন্দাদের বেজায় মনে ধরেছে। বাদুড় সংরক্ষণে আফ্রিকার মোমবাসা, পাপুয়া-নিউগিনির আদিবাসী গ্রাম কিংবা নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড শহরতলির বাসিন্দাদের সঙ্গে এক বন্ধনীতে তাই ঠাঁই হয়েছে মধ্যমগ্রামের ওই এলাকার। পাটুলির ‘অবদানের’ কথা ইতিমধ্যেই তাদের বার্ষিক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ইউনেপ। আন্তর্জাতিক বাদুড়-বর্ষে ফেসবুকে ইউনেপ-এর বিশেষ পেজ জুড়েও এখন বাদুড়তলার ‘র্কীর্তি’। আর, পাটুলির এই ‘অভিনব উৎসাহ’ সকলের সামনে তুলে ধরতে এলাকার দুই প্রতিনিধিকে ২০১৩-র ১২ ফেব্রুয়ারি নাইভাসায় নেমন্তন্নও করে চিঠি দিচ্ছে তারা।
ইউনেপ-এর জনসংযোগ আধিকারিক ভেরোনিকা লেনারজ্ বলেন, “ওঁরা বুঝতে পারছেন না, নিজেদের অজান্তেই কতটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিশ্চুপে করে চলেছেন। আমরা ওঁদের কথা শুনতে আগ্রহী। বাদুড় সম্মেলনে ওঁদের তাই আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।”
আবদালপুর, হুমাইপুর, শ্রীনগর এলাকায় সব্জির ফলন চোখ জুড়িয়ে দেয়। ফলের বাগানে বাদুড়ের দৌরাত্ম্য রয়েছে তবে স্থানীয় বাসিন্দা প্রণতি মণ্ডল বলেন, “পাড়ার ছেলেপুলেরা গাছ থেকে আম-কলাটা পেড়ে খায়। বাদুড়গুলোও তো পাড়া-পড়শির মতোই। একটু ফেলে ছড়িয়ে পেয়ারা-লিচু খায়।” এটুকু মেনে নিলে বাদুড়কুলের দৌলতেই যে তাঁদের খেত খামারে শস্যহানি কমেছে, স্থানীয় বাসিন্দারা তা বুঝছেন। বাদুড় নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করছেন আমদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশীল নায়েক। তিনি বলেন, “শস্যহানি করে এমন বহু পতঙ্গ রয়েছে যাদের একমাত্র যম বাদুড়। প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে বাদুড়ের তাই জুড়ি নেই।”
মধ্যমগ্রামের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৃণমূলের নজরুল ইসলাম। লাগোয়া ১৫ নম্বর আবার সিপিএমের, পুর-প্রতিনিধি ভাস্কর নায়েক। নজরুল বলেন, “যত বিরোধই থাক, বাদুড়-বাঁচানোর প্রশ্নে অন্তত ধর্ম-রাজনীতির লক্ষ্মণরেখা মুছে ফেলেছি আমরা।”
বছর কয়েক আগে, প্রখর জৈষ্ঠ্যে অজস্র বাদুড় মারা গিয়েছিল পাটুলিতে। ভাস্কর বলেন, “গরম পড়লেই তারপর থেকে গ্রামবাসীরা গ্রীষ্মে নিজের খরচে ওই বট, চালতার জঙ্গলে জল ছিটিয়ে দেন। গ্রামে এলেই দেখতে পাবেন, ওদের স্বস্তি দিতে গ্রীষ্ম-দুপুরে গ্রামের কেউ না কেউ গাছে জল স্প্রে করছেন।” বসে প্রহরাও। সত্তর পেরনো আব্দুর রহমান মাদুর পেতে প্রতি দুপুরে বটতলায়। বলেন, “পড়শি তো, তাদের রক্ষা করতে হবে না!”
নাই বা হল স্বজাত-ধর্ম, ‘বাদুড়ের মৃদু অবিরত আসা-যাওয়া’ বুক দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন জুম্মানরা। |