প্রবন্ধ ...
সবাই কাঁদছিলেন কিন্তু তার পর?
ভিনয় শেষ। তিনি একটি হাউসকোট জড়িয়ে নিচ্ছেন গায়ে। ধীরে ধীরে সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। অ্যাকাডেমি মঞ্চের তাবৎ দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে মুখর করে তুলছেন সে সন্ধ্যা। সবার চোখে জল!
‘মণিপুর কলাক্ষেত্র’র সাবিত্রী হেইসনাম করজোড়ে মাথা নোয়ালেন। অভিনন্দন আর আবেগের জোয়ারে যখন গোটা প্রেক্ষাগৃহ ভেসে যাচ্ছে, হাসলেন ষাটোর্ধ্ব সাবিত্রী। বড় স্নিগ্ধ আর নরম সে হাসি। ‘দ্রৌপদী’ থেকে তিনি যেন তখনও পুরোপুরি প্রবেশ করেননি সাবিত্রী হেইসনাম-এ! এর কিছু আগে সেনানায়কের সামনে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল দ্রৌপদী। ধর্ষিত, অত্যাচারিত, ‘বানিয়ে ফেলা’ দ্রৌপদী! উগ্রপন্থী দলের সক্রিয় সদস্য দ্রৌপদী! মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’ সেনানায়ককে প্রশ্ন করছে, ‘কাপড় কী হবে, কাপড়? লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? মরদ তু?... হেথা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরাতে দিব না। আর কী করবি?’
প্রতিবাদের ভাষাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে পরনের কাপড় খুলে ফেলে সেনানায়কের সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ায় দ্রৌপদী, সেই ভাষাই মঞ্চ ছেড়ে নেমে এসে মিশে যায় জীবনে! আর তাই ক’দিন আগের সেই সন্ধ্যায় কলকাতার নাগরিক সমাজের চোখের জলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল তীব্র ধিক্কার।
সে সন্ধ্যার সেই স্বতঃস্ফূর্ত চোখের জল দেখে মনে হচ্ছিল, এই প্রতিক্রিয়াই তো স্বাভাবিক! সাবিত্রী যে রাজ্যের নারী, অসম রাইফেলসের কয়েক জন জওয়ানের হাতে সেই রাজ্যেরই আর এক নারী থাংজাম মনোরমার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল প্রতিবাদের আর এক সর্বজনীন ভাষা! ১৫ জুলাই, ২০০৪ মণিপুরের কাংলা দুর্গের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বেশ কিছু নারী। অসম রাইফেলসের তৎকালীন সদর দফতরের সামনে দু’হাতে ফেস্টুন তুলে সেই ভারতীয় নারীরা চিৎকার করেছিলেন, ‘ভারতীয় সেনা, এসো, আমাদের ধর্ষণ কর।’
সেই সন্ধ্যাই আর এক প্রশ্নেরও জন্ম দিয়ে গেল। মনে হল, যে নাগরিক সমাজ প্রেক্ষাগৃহে বসে এমন এক আবেগের বিচ্ছুরণ ঘটায়, প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে সেই সমাজটাই কোথায় মিশে যায়! এ রকম ভাবনার আরও বড় কারণ, সেই দিন প্রেক্ষাগৃহে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই যথার্থ অর্থে নাগরিক সমাজের সুপরিচিত মুখ। মনে হল, আমাদের নাগরিক সমাজও তো এ রকম কত সত্যিকারের প্রতিবাদের জন্ম দিতে পারে! জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখে! না, রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে হুবহু দ্রৌপদীর মতো প্রতিবাদের স্বর তুলতে বলছি না। মণিপুরের জননীরা প্রতিবাদের যে পথ বেছে নিয়েছেন, আমাদের চার পাশে সব সময় সেই চরম পথ বেছে নেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু, তার বাইরেও প্রতিবাদী স্বরটা আরও চড়ানোর বিস্তর সুযোগও যে আছে!
অজস্র অনিয়ম আর পেশিশক্তির ভয়াবহ প্রদর্শন ঘটে চলেছে যে সমাজে, সেই সমাজের নাগরিক-প্রতিবাদ আরও একটু ছড়িয়ে পড়ুক না কেন ভিন্ন ভাষায়! সব কিছুই সরকার আর রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে বসে সমালোচনার এই নাগরিক-অভ্যাসটাও না হয় একটু একটু করে পাল্টানো যাক! সে চেষ্টা নিষ্ফল হত না কিন্তু। নিছক তরজার বাইরে বেরিয়ে গিয়ে নাগরিক আন্দোলনের বাহুবন্ধনে আরও অনেক প্রান্তিক মানুষকে বেঁধে ফেলা যেত।
সে দিনের সন্ধ্যায় ‘দোপ্দী মেঝেন’ সাবিত্রী হেইসনাম কি এই শিক্ষাও দিয়ে গেলেন না!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.