মঞ্চের পিছনে একটি প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে ব্যান্ডের ছেলেরা গাইছে: “আট্টা বছর কেটে গেছে গ্যালিলিও এখন আটান্ন/ সূর্য্য দাঁড়িয়ে পৃথিবী ঘুরছে এই নিয়ে আর চর্চা হয়নি কোনো...” এর পরই খবর এল হোলি পোপ মৃত্যুশয্যায় এবং সম্ভবত নতুন পোপ হতে চলেছেন ‘Cardinal Barberim’, এক জন ‘বিজ্ঞানী’। স্বয়ং পোপের চেয়ারে এক জন ‘বিজ্ঞানী’! উত্তেজনায় গালিলেয়ো গালিলেই অনেকগুলো বছর পর আবারও সূর্যের দিকে টেলিস্কোপটা তাক করলেন, বললেন:
গালিলেয়ো: এর মানে একটাই। পরিবর্তন আসছে। আমরা হয়তো শেষমেশ সেই দিনটা দেখতে পাব, যখন আমাদের ফিশফিশ করে বলতে হবে না দুয়ে দুয়ে চার হয়।
বের্টোল্ট ব্রেখ্ট-এর সুবিখ্যাত নাটকের কথা আমরা সবাই জানি। আমরা জানি, পোপের কুরসিতে এক জন বৈজ্ঞানিক এসেও কোনও লাভ হয়নি ‘সত্য’, ‘বিজ্ঞান’, সমস্ত কিছুকে নস্যাৎ করে ফ্লোরেন্সের আদালত তার রায় দিল, পবিত্র চার্চকে অসম্মান ও অস্বীকার করার অপরাধে গালিলেয়োকে গ্রেফতার করা হল, রোমে ইনকুইজিশন হল। গালিলিয়োকে টর্চার করা হল না, শুধু দূর থেকে ছুরি, সাঁড়াশি, গরম লোহার শিক এ সব দেখানো হল এবং গালিলেয়ো গালিলেই জনসমক্ষে স্বীকার করলেন, তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেছেন, তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।
কী আশ্চর্য, এই নাটকের স্রষ্টা বের্টোল্ট ব্রেখ্ট যখন নাতসিদের ভয়ানক উৎপীড়ন এড়াতে আশ্রয় নিলেন আমেরিকায় এবং সেখানে এসে দেখলেন ‘ধনতন্ত্রের সীমাহীন লোভের হাঁ-মুখ’, তখন একটা সময় তাঁকেও অভিযুক্ত করা হয় ‘আনআমেরিকান অ্যাক্টিভিটিজ’-এর সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে এবং তিনিও প্রকাশ্য আদালতে স্বীকার করেন ডাহা মিথ্যে কথা বলেন তিনি কমিউনিস্ট নন।
এ কি ক্ষমতার কাছে নতিস্বীকার? না কি এ এক রকম কৌশল?
নাটকের শেষে প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ গালিলেয়ো গালিলেই বলেন তাঁর পরমপ্রিয় ছাত্র যুবক আন্দ্রেয়াকে:
গালিলেয়ো: এসো বন্ধু আমার, সহকর্মী আমার, নেমে এসো প্রবঞ্চনার নর্দমায়... আমি নিজেকে বেচে দিয়েছি। তুমি কিনে নাও আমাকে। বেঁচে থাক আমাদের মৃত্যুভয়, আমাদের যুক্তি, আমাদের পরস্পরকে চুনকাম করার অভ্যেস... আমি ক্ষমতার কাছে আমার জ্ঞানকে সারেন্ডার করে তাকে অপব্যবহার করেছি... |
সম্প্রতি শ্রীঅঞ্জন দত্তের অসামান্য প্রয়োগ পরিকল্পনায় তৈরি এই নাটক দেখে আবারও কত শত সংশয় আর প্রশ্নের ঢেউ উঠল মনে। মহান ও বিরাট মাপের সব মানুষ, যাঁরা এক এক জন এক একটা যুগকে পাল্টে দিয়েছিলেন, সেই সব মহৎ স্রষ্টা থেকে শুরু করে আমার মতো চুনোপুঁটিআমরা ভয় পাই কেন? ঠিক কোথায়, কী ভাবে আমরা বাধ্য? শুধুই ‘ক্ষমতা’ আমার গলায় বক্লস পরাচ্ছে? শুধুই ‘লাল-সবুজ-গেরুয়া’ পতাকার শাসানির ভয়? না কি, আমার ভিতর একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে আমায় সর্বক্ষণ বলছে, “বেঁচে থাক আমাদের পরস্পরকে চুনকাম করার অভ্যেস”....
আমি কি আমাকেই সারা ক্ষণ বোঝাচ্ছি যে, কোথায় কোনও এক বাজারে, কোনও এক মৎস্য ব্যবসায়ীকে সি পি আই (এম)-এর মিছিলে যাওয়ার অপরাধে যদি কিছু ‘তৃণমূল’-এর রাজনৈতিক কর্মী ব্যবসা বন্ধ করার ফতোয়া দেয় এবং তার বিরুদ্ধে যদি এক জন অভিনেতা ও নাট্যকর্মী প্রতিবাদে গিয়ে চরম অপমান ও হেনস্থার স্বীকার হন, তা হলে এটা সব মিলিয়ে একটা অতীব সামান্য ঘটনা! কিন্তু আমার ভিতর আর একটা মানুষ কেন সঙ্গে সঙ্গেই বলল, এ বড় ভয়ঙ্কর কথা, এই ঘটনাকে সামান্য বলে ভাবলে, ভবিষ্যতে আমি যদি অন্ধ ও বধির হয়ে যাই, আমার মস্তিষ্কে যদি ‘জারি হয় কারফিউ’, তখন? ‘পশুখামার’ নাটক বন্ধের প্রতিবাদ যদি আমি করতে পারি, যদি কোনও এক সি পি আই (এম)-এর দাম্ভিক ও হঠকারী নেতা’র ওই ফতোয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি, তবে কেন আমার মোবাইল ফোনে ভেসে উঠবে এমন এস এম এস: “বিমল চক্রবর্তীর ঘটনা কোনও ভাবেই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত নয়, নাট্য অঙ্গনকে নোংরা রাজনীতির হাত থেকে বাঁচাতে, আসুন ১৩ই অক্টোবর, শনিবার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে, বিকেল চারটে...’
কোনও সন্দেহ নেই, বিমল চক্রবর্তীর উপর হামলার বিরুদ্ধে ৫ অক্টোবর যাঁরা ‘প্রতিবাদ সভা’ ডেকেছিলেন, অতীতে তাঁদের অনেককে দেখেছি সি পি আই (এম)-এর ঘৃণ্য কাজগুলির সমর্থনে নির্লজ্জ ওকালতি করতে, শুধু মুখে নয়, লিখে। সেই সব স্মৃতি ভোলা যাবে না, তাই যেতে ইচ্ছে করলেও, পারিনি।
কিন্তু ১৩ অক্টোবর যাঁরা পাল্টা সভা ডাকলেন, যাঁদের পাশে পাশে আমিও হেঁটেছি অনেকটা পথ, যখন পশ্চিম বাংলার মানুষ বামশাসনের জাঁতাকল থেকে মুক্তি চাইছিলেন, সেই সব শিরদাঁড়া সোজা রাখা মানুষেরা সভার বহু আগে থেকেই তৈরি করে দিলেন এক ‘রূপরেখা’। ‘সরকার ও তৃণমূল নেত্রীর প্রতি যাঁরা পূর্ণভাবে আস্থাশীল, কেবল তাঁরাই যোগ দেবেন ওই সভায়।’ প্রকাশ্য সভায় কী হল? ‘সিপিএমত্ব’র বিরুদ্ধে ‘তৃণমূলত্ব’ (!) দেখানোর আস্ফালন। বিমল চক্রবর্তীকে গ্রুপ ‘ডি’ কর্মী বলে কটাক্ষ করে, তাঁকে ‘কমপালসারি ওয়েটিং’-এ পাঠানোর সরকারি নির্দেশিকাকে মিথ্যা অপপ্রচার বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন কেউ (পর দিন ভুল স্বীকারও করলেন)।
এবং সর্বোপরি ‘নাট্যস্বজন’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার কথা জানিয়ে প্রকাশ্যে বলা হল, ‘জনাদেশে হেরে ক্ষমতা হারিয়েছেন, এ বার পঞ্চায়েতে হারবেন।’ এই বার আক্ষরিক অর্থেই সত্য হয়ে উঠল এস এম এস-এর বাণী, ঘটনাপ্রবাহ থেমে থাকল না ‘থিয়েটার কর্মীর’ উপর নিগ্রহের ‘প্রতিবাদ’ বা ‘না-প্রতিবাদ’-এর তর্কবিতর্কের মধ্যে। ঘটনাপ্রবাহ আমাদের টেনে দাঁড় করাল এমন একটা খাদের সামনে, যে আমরা সাংস্কৃতিক কর্মীরা রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার নৈতিক অধিকারটা হারাতে বসলাম। যে সি পি আই এম মানুষকে একটা গভীর অন্ধকূপে ঠেলে দিয়েছিল, এবং যে তৃণমূল কংগ্রেস সব পরিবর্তন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাসন ক্ষমতায় এল, তারা উভয়ই তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে কোনও পথ অবলম্বন করতে পারে (যে কোনও রাজনৈতিক দলই পারে), কিন্তু ‘আমরা’ কি জানতাম, বা এখনও জানি, আমরা কত দূর যেতে পারি? কত দূর যাওয়া সম্ভব?
বিমল চক্রবর্তীকে নিগ্রহকারী কিছু গুন্ডা দেখল, এখন তাদের আড়াল করার জন্য রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের প্রয়োজন হয় না, ‘সত্য না মিথ্যা’ এই বিতর্কে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা হল গুন্ডাদেরই। অপর দিকে ‘বিমলদা’র পরিবারকে ‘সাহস’ জোগানোর অছিলায় সি পি আই (এম)পন্থী সেই নাট্যব্যক্তিরা স্থির করেছেন পুনরায় ১৭ অক্টোবর বিমলদার পাড়ায় একটা সভা করবেন। যদি তা হয়, তা হলে নিশ্চিত ভাবেই তাঁরা ‘তৃণমূলত্ব’ ও ‘সিপিএমত্ব’র থিয়োরিকে পুষ্ট করতে সাহায্য করবেন।
অথচ ভাবলে অবাক লাগে, ভাগাভাগির এই ইতিহাসকে যদি ‘চিরকেলে’ বলে মেনেও নিই, তা হলেও দেখব, এক অন্যতর ইতিহাসও কথা বলছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ছোটো বকুলপুরের যাত্রী’ গল্প থেকে নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে, নানান তথ্য ঘেঁটে জানতে পারি পাক্কা কংগ্রেসি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক মত ও পথের সম্পূর্ণ বিরোধী হয়েও নানান বিষয়ে সমর্থন করছেন ও তাঁর বিপদে এগিয়ে আসছেন, মানিকও চিঠির মাধ্যমে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছেন তারাশঙ্করকে।
সুতরাং লোকদেখানো সভা নয়, বিমলদা ও তাঁর পরিবারকে বোঝানো প্রয়োজন ‘তোমাদের বিপদে আমরা আছি’। সেটা সব সময় সভাসমিতি না করেও বোঝানো যায়, বোঝানো যায় নিজেদের যে, অবশ্যই একটা নির্বাচিত সরকার বা একটি যে কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা থাকবে, কিন্তু তার থেকেও বেশি প্রত্যাশা আমার নিজের কাছে নিজের, কারণ থার্ডবেল পড়ার পর প্রেক্ষাগৃহের আলোগুলো যখন নিভে যায়, ‘ওভারচার’ বেজে ওঠে, পর্দা সরে যায়, অভিনেতার প্রথমে মনে হয়, সে দর্শকদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, অচিরেই তার ভুল ভাঙে, সে বোঝে, সে আসলে দাঁড়িয়ে তার নিজেরই মুখোমুখি। |