পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ স্বয়ং পাঠ্য বই প্রস্তুত করিবে, সম্প্রতি এমনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হইয়াছে। ইহাতে কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকরা ক্ষুব্ধ। বই প্রকাশ হইতে কেবলমাত্র বই ছাপিবার সংস্থা হইয়া উঠিতে তাহারা স্বভাবতই আপত্তি করিবে। কিন্তু প্রকাশকদের স্বার্থই এখানে প্রধান বিবেচ্য নহে। এই বিষয়ে আলোচনার কেন্দ্রে রাখিতে হইবে ছাত্রদের স্বার্থ। তৎসহ নীতির প্রশ্নও রাখিতে হইবে। প্রথমত, সকল ছাত্র এক পাঠ্য বই পড়িলেই পঠনপাঠনের মানে সামঞ্জস্য আসিবে, শিক্ষা দফতরের এই যুক্তি হাস্যকর। অঙ্ক কিংবা ইংরাজিতে একই বই সারা রাজ্যে ব্যবহৃত হয়, তাহার জন্য মানে সমতা আসিয়াছে বুঝি? যে সকল বিদ্যালয়ে অন্যান্য বিষয়ে ছাত্ররা ভাল ফল করিতেছে, সেখানে অঙ্ক ও ইংরাজিতেও ভাল করিতেছে। দুর্বলতর প্রতিষ্ঠানগুলিতে সকল বিষয়েই ফল খারাপ হইতেছে। পাঠ্যবইয়ের অভিন্নতা দিয়া পড়াশোনার মানে সামঞ্জস্য আনা সম্ভব নহে। সামঞ্জস্যের জন্য প্রয়োজন একই পাঠক্রম, তাহা তো পর্ষদ বরাবরই স্থির করিয়া দিতেছে। সেই পাঠক্রম মানিয়া কোনও লেখক যদি অন্যদের হইতে ভাল বই লিখিতে পারেন, তাহা হইলে বিদ্যালয়গুলি সেই বই নির্বাচন করিবেন না কেন? কেনই বা ছাত্ররা তাহা পড়িবার সুযোগ হইতে বঞ্চিত হইবে? পর্ষদ কী প্রকারে দাবি করিতে পারে যে, তাহাদের নির্দিষ্ট লেখকের বইটিই শ্রেষ্ঠ? পর্ষদের ন্যায় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান গ্রহণযোগ্যতার ন্যূনতম শর্তগুলি নির্দিষ্ট করিতে পারে, উৎকৃষ্টতার বিষয়ে শেষ কথা বলিতে পারে না। তাহা শিক্ষক এবং ছাত্রদের আদানপ্রদান এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই স্থির হইবে। পর্ষদের অনুমোদন ব্যতীত কোনও পাঠ্য নির্বাচিত হয় না, ইহাই কি মানের সামঞ্জস্যের জন্য যথেষ্ট নহে? কেহ বলিতে পারেন, ইহার আসল উদ্দেশ্য দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ। কোন পাঠ্যপুস্তকটি নির্বাচিত হইবে, তাহা স্থির করিবার পদ্ধতি স্বচ্ছ নহে। অনেক প্রকাশকই নিজের বইটি অনুমোদনের জন্য এবং নির্বাচনের জন্য নানা প্রকার উৎকোচ দিয়া থাকেন। অতএব তাহা তুলিয়া সরকারি পুস্তক চালু করিলেই ভাল। উত্তরে বলা চলে, যে প্রক্রিয়ায় কাজ করিতে গেলে দুর্নীতি হইতেছে, সেখানেই সেই প্রক্রিয়াকে বাদ দিতে হইবে, এমন ভাবিলে প্রশাসনই অচল হইয়া যাইবে। যেখানে লাভের আশা রহিয়াছে, সেখানেই দুর্নীতি আসিয়া ঢুকিবে, ইহা প্রায় অবধারিত। নির্বাচন প্রক্রিয়াতেও নানা দুর্নীতি চলিতে থাকে, তাহার জন্য নির্বাচন বন্ধ করা গণতন্ত্রে সম্ভব নহে। বিচার ব্যবস্থা যে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নহে, এমন কথা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী কিছু দিন পূর্বে ঘোষণা করিয়া সমস্যায় পড়িয়াছেন। কিন্তু তাহার জন্য আদালতের ক্ষমতাকে খর্ব করা সম্ভব নহে। প্রশাসনেরও নানা স্তরে নানা দুর্নীতি চলিতেছে, তাহার জন্য কি নির্দিষ্ট আধিকারিকের হাত হইতে তাহার ক্ষমতা কাড়িয়া লওয়া হইবে? দুর্নীতি বন্ধ করিতে হইলে সরকারি বা বেসরকারি, যে কোনও সংস্থার উপর নজরদারি বাড়াইতে হইবে, তাহাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করিতে হইবে। প্রতিদিন নূতন নূতন বিধি ঘোষণা করিয়া পুরাতন সমস্যার সমাধান পাওয়া যাইবে না, বরং নূতন সমস্যা সৃষ্টি হইবে। |