ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রদত্ত নোবেল শান্তি পুরস্কারটিকে ঐতিহাসিক সান্ত্বনা পুরস্কার বলিয়া অভিহিত করিলে ভুল হইবে না। ঐতিহাসিক, নিতান্ত আক্ষরিক অর্থেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সৃষ্টির পিছনে রহিয়াছে যুদ্ধ-শান্তির ইতিহাস। সেই ইতিহাস স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি, দুই গোত্রেরই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের দুই বছরের মধ্যে, ১৯৪৭ সালের মে মাসে লন্ডনে ‘ইউনাইটেড ইউরোপ মুভমেন্ট’-এর আনুষ্ঠানিক সূচনা। ইতিহাসবিদ ফার্নান্দ ব্রোদেল লিখিয়াছিলেন, ‘(সম্মিলিত ইউরোপ গঠনের) সমস্ত উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৪৫-এর পরে ইউরোপের ভয়াবহ দুর্দশার কারণেই।’ তিন দশকের মধ্যে দুই-দুইটি মহাযুদ্ধ, ভয়াবহ অবশ্যই। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলে, ইউরোপে যুদ্ধের ইতিহাস অতি প্রাচীন, কার্যত আদিপর্ব হইতেই মহাদেশটি রণ-অক্লান্ত। মহাযুদ্ধ এক অর্থে সেই ইতিহাসের চরম অধ্যায়, অন্তত এই অবধি। স্বভাবতই ই ইউয়ের নোবেল প্রাপ্তির সমর্থকরা বলিতেছেন, জার্মানি এবং ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ আজ যতটা অকল্পনীয়, মাত্র কয়েক দশক আগেও তাহা ততটাই স্বাভাবিক ছিল, ইহা যুদ্ধ হইতে শান্তির পথে ঐতিহাসিক উত্তরণ বইকী। সুতরাং যদি এমন কথা বলা হয় যে, এই পুরস্কার পাইয়াছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিহাস, তবে সেই প্রাপ্তি অস্বাভাবিক বা অসঙ্গত নয়।
প্রশ্ন উঠিবে, ই ইউ ইউরোপীয় শান্তির পরিণাম বা প্রতীক নিশ্চয়ই, কিন্তু ওই শান্তির সৃষ্টি ও লালনে তাহার ভূমিকা কতটুকু? প্রশ্নটি অন্যায্য নয়। যুদ্ধোত্তর ইউরোপের শান্তির প্রকৃত কারণ ‘ঠান্ডা লড়াই’ অর্থাৎ দুই মহাশক্তির ভারসাম্য। সেই পর্বের অবসানের পরে পূর্ব ইউরোপের সংঘাত দমনে ই ইউয়ের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না বটে, কিন্তু সেই ভূমিকাকে যথেষ্ট সফল বলিবারও উপায় নাই ইউরোপীয় নেতারা কসোভোর ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার কাহিনি যতটা স্মরণ করেন, যুগোস্লাভিয়ার ভাঙনপর্ব প্রথম হইতে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনায় ব্যর্থ হইবার কাহিনি ততটাই আড়ালে রাখিয়া দেন। তবু, ইউরোপীয় শান্তির প্রতীক হিসাবে ই ইউয়ের গুরুত্ব মানিতে কোনও বাধা নাই। নোবেল কমিটি যখন মনে করাইয়া দেন যে, সাতাশটি দেশের পঞ্চাশ কোটি মানুষের এই গোষ্ঠীটি গত কয়েক দশকে ইউরোপে শান্তির এক নূতন ভুবন সৃষ্টিতে সাহায্য করিয়াছে, সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করিবার কোনও উপায় থাকে না।
কিন্তু বাস্তব তো ইতিহাস নয়, প্রতীকও নয়। ইউরোপের বর্তমান বাস্তব কি নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য? ই ইউয়ের আর্থিক সঙ্কটের ব্যাপ্তি এবং গভীরতা এমন অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে যে, তাহার অস্তিত্বই বিপন্ন। সম্মিলিত ইউরোপের প্রথম এবং প্রধান অভিজ্ঞান যে অভিন্ন মুদ্রা, সেই ইউরোর ভবিষ্যৎ তমসাচ্ছন্ন। আর শান্তি? সংহতি? এক দিকে আর্থিক বিপর্যয়, অন্য দিকে বিপর্যয়ের মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যবস্থাপত্র দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে একের পর এক দেশ অগ্নিগর্ভ অশান্তিতে উত্তাল। সেই অশান্তিকে সম্পূর্ণ ‘অন্তর্দেশীয়’ বলিলেও ভুল হইবে উত্তমর্ণ জার্মানির বিরুদ্ধে গ্রিস বা স্পেনের বিপন্ন নাগরিকদের বিরাগ এখন আর বাগ্যুদ্ধে সীমিত নাই। বস্তুত, আর্থিক সঙ্কটের চাপে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক গত এক বছরে যে অতলে পৌঁছাইয়াছে, তাহাকে অভূতপূর্ব বলিলে ভুল হইবে না। এমন একটি দেশগোষ্ঠীকে শান্তি পুরস্কার দিয়া নরওয়ের নোবেল কমিটি কি পরিহাস করিতেছেন? এই প্রশ্ন কেবল ওঠে নাই, প্রবল স্বরে উচ্চারিত হইয়াছে। বিপন্ন, পর্যুদস্ত, অশান্ত, অক্ষম, পারস্পরিক অবিশ্বাসে ও গভীর আত্মগ্লানিতে দীর্ণ একটি গোষ্ঠীকে পুরস্কার দেওয়ার মধ্যে কেহ নির্মম পরিহাস খুঁজিতে চাহিলে তাঁহাকে দোষ দেওয়া কঠিন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রধান এই পুরস্কারকে একটি ‘প্রেরণা’ হিসাবে বরণ করিয়াছেন। বাঁচিয়া থাকিবার জন্য যদি নোবেল শান্তি পদকে প্রেরণা খুঁজিতে হয়, তবে বুঝিতে হইবে, মহাদেশটির দশা তাহার মানচিত্রের মতোই ছিন্নবিচ্ছিন্ন। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জীবনবৃত্তান্ত বরাবরই বিতর্কিত, রাজনীতি-লাঞ্ছিত। কিন্তু সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে তাহার ব্যবহার ঈষৎ অভিনব বটে। |