ঘাটের চাতালে অন্ধ গায়কটিকে দেখলে দিনের ব্যস্ততম পুরুতঠাকুরেরও হিংসে হওয়ার কথা।
বাগবাজারের মায়ের ঘাটে চাদর বিছিয়ে কীর্তনে বিভোর সাদা ফুলশার্টধারী। সেফটিপিন-বিদ্ধ রাশি-রাশি ৫০০ টাকার নোট তাঁর অঙ্গের আভরণ। জামার কলার, বুকপকেট, হাতা কিচ্ছু বাকি নেই। সামনে থালাতেও জমা হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি খুচরো পয়সা, দশ-বিশ-একশো টাকার নোট।
সোমবার মহালয়ার ভোরে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়েছে থিকথিকে ভিড়। তার এক পাশে চলছে, ‘হরিনামের জপমালা, যতই বাড়ে জ্বালা’। গায়ককে দেখে টুকরো মন্তব্য, দেখ দেখ বাঙালি গুণের কদর জানে! শুনেই কীর্তন থেমে গেল। কালো কাচের চশমা নাকে নামিয়ে গায়ক নিজের জামায় একটু হাত বুলিয়ে নিলেন। তার পরে বললেন, “আজ্ঞে না, এ সবই মাড়োয়ারি ভক্তের নিবেদন।”
আম-বাঙালির তর্পণ-পর্বে মিশে যাচ্ছে এমন রংবেরঙের রগুড়ে মশলার ফোড়ন। পিতৃ-মাতৃকুল দু’দিকে, অত জনের নাম মনে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়! অনেকেই লিখে এনেছেন। ভিজে হাতে সেই কাগজ লেপ্টে ভক্তিভরে কোষাকুষির জল ঢালতে গিয়ে গেরো। কে যেন ছিলেন, ঠাকুরদার পিতা! ভিজে চুপচুপে কাগজে লেখাটা পড়া যাচ্ছে না।
পিছল ঘাটে বিপত্তি সামলাতে পুলিশেরও মাথাব্যথার শেষ নেই। আহিরীটোলা-বাগবাজারে নৌকোয় চেপে লাউডস্পিকার ফুঁকে বৃদ্ধ কনস্টেবল ‘হুঁশিয়ার’ করে চলেছেন। লাইন ভেঙে শর্টকাটে তর্পণ সারতে পিছল ঢাল বেয়ে তবু অত্যুৎসাহীর ভিড়। |
পূর্বপুরুষের স্মৃতিভারে যাঁরা ডুবে থেকেছেন, এ সকালটা তবু শুধু তাঁদের জন্য নয়। আহিরীটোলার চায়ের দোকানে ১০-১৫ কেজি ময়দা মজুত রেখে বচ্ছরকার লুচি ভাজা। বাড়িতে মিহিদানা বা মাখা সন্দেশ পাক করে বাবুঘাটে অ্যামেচার ময়রার পসরা। বাদুড়িয়ার জগাই খান, বাবলু মাঝিদের নৌকোয় গঙ্গায় ইলিশ ধরার চ্যালেঞ্জ। কেক-জিলিপির দেদার ভিক্ষায় বসিরহাটের রুকসানা-সলমাদের পোয়া বারো। ঘাটে ঘাটে বারমুডাধারী সাহেব পর্যটক থেকে শখের ফোটোগ্রাফার-বাহিনী। মহালয়ার তর্পণ, নমাজ থেকে গঙ্গার সন্ধ্যারতি সবের জন্যই যাঁরা মুখিয়ে থাকেন।
পিতৃপক্ষের শেষ লগ্নে গঙ্গাবক্ষে এবিপি আনন্দের প্রভাতফেরিতে এমন টুকরো ছবির কোলাজ। উদয়নারায়ণপুর থেকে ‘ফার্স্ট বাস’ ধরে বাগবাজারে হাজির ঠাকুরমশাই বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে পেয়ে তর্পণ সারতে আসা পুরনো বন্ধু দুলাল দত্তের আহ্লাদের শেষ নেই। বৈদ্যনাথকে প্রণাম ঠুকে কড়া হুকুম, “বামুনের বেটা, গুছিয়ে আশীর্বাদ কর। নইলে দেখবি মজা!”
আলোর বেণুর ভোরে এমন অনেক যুগের হাত ধরাধরি। ঘাট থেকে উঠতে মন চায় না কালীঘাটের চায়না হালদারের। “মা-বাবা-দিদির নামে তর্পণ সারলাম, আমার আর কেউ নেই গো,” বলে উঠলেন তিনি। টকটকে লাল সূর্য তখন সোনার রঙে গঙ্গায় মিশে গিয়েছে।
তলিয়ে গেল কিশোর। গঙ্গায় তর্পণ করতে নেমে তলিয়ে গেল এক কিশোর। পুলিশ জানায়, কাশীপুরের বিশাল সাউ (১২) ভোরে সর্বমঙ্গলা ঘাটে নেমেছিল। |