মুশকিলে পড়েছেন দিদিমা। রাত হয়েছে অনেক। নাতির ঘরে ফেরার নাম নেই। ফিরবে কী? নাতি তখন বুঁদ মণ্ডপে কাটোয়ার শিল্পীর বাঁশের উপরে খোদাই করা কাজ ফ্রেমবন্দি করতে। অবশেষে ফিরতেই শুরু হয়ে গেল দু’জনের ধুন্ধুমার তর্ক। ‘বছর বছর তো সেই একই পুজো। ওতে দেখবার কী আছে?’ দিদিমার প্রশ্নের জবাবে নাতির মন্তব্য, ‘পুজোগুলোও মোটেই এক নয়, প্রতিটা পুজোই নিজের মতো।’
তাঁরা কেমন করে তাঁদের মতো বোঝাতে, দিদিমার সামনে পুজোর ছবিগুলো মেলে ধরল নাতি। বরাহনগরের কর্মী সঙ্ঘ। সাবেক আর থিমের মিশেলে তাঁদের ভাবনা ‘শিউলি সৌরভে, মেতেছি ভৈরবে।’ নেপালের ভৈবব মন্দিরের আদলে তৈরি এই মণ্ডপে থাকছে কাল, ক্রোধা-সহ আট ভৈরব আর এক হাজার ঘণ্টা। একই আদলে সাজছে প্রতিমাও। হারিয়ে যেতে বসা কাঠ খোদাই শিল্প এ বার হাতিয়ার লেকভিউ পার্ক সর্বজনীনের পুজোয়। তাঁদের থিম ‘গজবংশে যামিনী’। থিম রূপকার অশোক সরকারের পরিকল্পনায় বিশালাকার হাতির আদলে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। বাঁশ ও কাঠ খোদাই করে তুলে ধরা হবে যামিনী রায়ের শিল্পকর্মকে।
শুনে দিদিমা বললেন, ‘ছোটবেলায় এ কাজ গ্রামে হত, আবার দেখতে পাব।’
উপস্থাপনায় কলকাতার পুজোকে টেক্কা দেওয়ার মনোভাব আলমবাজারের কলাকার পাড়া সর্বজনীনের পুজোয়। পরিবেশরক্ষাকে ঘিরে তাঁদের থিম ‘স্বর্গ-মর্ত্য’। দূষণের প্রভাব আর দূষণ মুক্ত পরিবেশের ছবি ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে মণ্ডপে। গাছ-গাছালিতে ঘেরা মণ্ডপে গ্যালভানাইজড টিন দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। পাইপ, ট্রানজিস্টার, ছোবড়া, সার্জিকাল গ্লাস-সহ বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহারে রূপ পাচ্ছে মণ্ডপ। শুধু মনোরঞ্জন নয়, ভাবনাকে আলোড়িত করতে চায় বেলঘরিয়া মানসবাগ স্পোর্টিং ক্লাব। তাই তাদের থিম বাংলার ব্রতকথা। লুপ্ত প্রায় ছয়শতাধিক ব্রতকথার অধিকাংশই তাঁরা ফুটিয়ে তুলবেন। লক্ষীর গাছকৌটোর আদলে ধান, জরি, ফাইবার পেন্টিং-এ সেজে উঠছে মণ্ডপ। মাটির ম্যুরালে শোভা পাবে ব্রতকথা। প্রতিমা হবে ব্রোঞ্জ রঙের। ব্যবহৃত হচ্ছে সীসাবিহীন রঙ। এত রকমের পাঁচালির ছবি দেখে দিদিমা স্বীকারই করে ফেললেন, এত ব্রতকথা তিনিও জানতেন না।
ছোট ছোট কাগজের মোড়কে জঙ্গলময় পরিবেশে বাঘ, সিংহ থেকে বিভিন্ন পাখি। শিল্পী সৌরভ দাসের পরিকল্পনায় এমন পরিবেশ উঠে আসছে পেপার কুইলিং শিল্পে। তাই মিলনগড় সর্বজনীনের পুজোর থিম ‘প্রকৃতির মাঝে, কাগজের সাজে।’ পাড়ার জলাশয়কে ঘিরেই তৈরি হচ্ছে বারাণসীর ঘাট, অলিগলি, মনোহারি দোকান। এ ভাবে এক টুকরো কাশী হাজির করে চমক দেওয়ার চেষ্টা করছেন নেতাজি কলোনি লো ল্যান্ড সর্বজনীন পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। ছবি দেখেই পেন্নাম ঠুকলেন দিদিমা। একই ভাবে কংক্রিটের শহরে গ্রামীণ পরিবেশ তৈরিতে বদ্ধপরিকর ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন। তাদের থিম গ্রামবাংলা ও কৃষি জীবন। মন্দিরের আদলে মণ্ডপে গ্যালভানাইজড তার দিয়ে ফুটে উঠবে সে ভাবনা। বাঙালি সঙ্ঘের পুজোয় শান্তির বার্তা। প্যাগোডার আদলে মণ্ডপ, অসুরবিহীন দুর্গা। থাকছে নানা চিত্রকলাও। বেলঘরিয়ার আর্যনগর কিশোর সঙ্ঘের পুজোতেও শান্তির আবাহন। আদিবাসী জীবন তুলে ধরছেন উদ্যোক্তারা। জঙ্গল ঘেরা গ্রামীণ পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা হবে। প্রতিমা অস্ত্রবিহীন। আদিবাসী চিত্রকলা থাকবে মণ্ডপে।
শরৎপল্লির পুজোয় আবার শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ছবি। জেলখানার আদলে মণ্ডপে মডেলের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হবে শিশুশ্রমিকদের যন্ত্রণা। সন্তানদের রক্ষাকর্তা হয়ে অভয়া রূপে বিরাজ করবেন মাতৃপ্রতিমা। অন্য রকম হওয়ার চেষ্টা রানিপার্ক সর্বজনীনের পুজোয়। সাবেক রীতিতেই থিমের প্রয়োগ, পুরাণের আবাহন। বিশালাকার বটগাছের মণ্ডপ। খড়, মাটি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। বটের ঝুড়ি দিয়েই প্রতিমা।
পুজোর ছবিতেই দিদিমা-নাতির তর্কের ইতি। নাতির কথার রেশ ধরেই বেলঘরিয়া বরানগর ও সংলগ্ন এলাকার পুজো উদ্যোক্তাদের দাবি, ‘কলকাতার পুজোর সঙ্গে তুলনা নয়, আমরা আমাদের মতো।’ |