|
|
|
|
‘শক্তিরূপেণ’ সমবায়ই নিয়ে এল অন্য পুজো |
অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
উৎসবের মরসুম কাটলে ক’দিন আর ভ্যানরিকশা টানবেন না ওঁরা কেউ। ব্যাক্স-প্যাঁটরার গোছগাছ এখনই শুরু। দুগ্গাপুজো মিটলেই বারাসত স্টেশন সংলগ্ন ভ্যানরিকশা স্ট্যান্ডের সবাই পুরী যাবেন সপরিবার।
মাইথন, বক্রেশ্বর, মুকুটমণিপুর ঘোরা হলেও জগন্নাথের মন্দিরটা যে এখনও দেখা হয়নি ওঁদের অনেকেরই।
দু’দশক আগে ছবিটা কিন্তু এমন ছিল না সেখানে।
রবীনবাবু, রবিবাবুর মতো স্ট্যান্ডের অন্য ভ্যানচালকের রিকশাতেই পুজোর ছুটিতে ছেলে-মেয়ে-বৌ নিয়ে স্টেশনে ট্রেন ধরতে যেতেন শহরের অফিসবাবুরা। দিনভর রিকশা টানার খাটুনির টাকায় ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’। বেড়ানোর চিন্তা তাঁদের কাছে তখন অলীক কল্পনা। দিবাস্বপ্ন।
স্বপ্নটা বাস্তব হয়ে ধরা দিল ১৯ বছর আগে। ‘পায়োনিয়ার অ্যাথলেটিক ক্লাব’-এর কয়েক জন সদস্যের চেষ্টায়। একটু একটু করে বদলে গেল স্ট্যান্ডের ৩৪ জন ভ্যানচালকের জীবন। তাঁরা ঠিক করলেন, ফি-দিন ভ্যানরিকশা চালানোর রোজগার থেকে ১০ টাকা করে জমা দিতে হবে তাঁদের নিজেদের একটা তহবিলে। টানা ১১ মাস। সকলের কাছ থেকে সংগৃহীত টাকা জমা পড়তে শুরু করল সমবায় ব্যাঙ্কের নবপল্লি শাখায়। ছোট্ট এই সঞ্চয়েই আমূল পরিবর্তন ওই ভ্যানচালকদের রোজনামচায়। তাঁরা জানালেন, প্রতিদিন ১০ টাকা করে ১১ মাসে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩৩০০ টাকা করে নেওয়া হয়। বিশ্বকর্মা পুজোয় তা থেকে তিন হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয় ভ্যানচালকদের স্ত্রী বা পরিবারের হাতে। একসঙ্গে পাওয়া ওই টাকা লাগে সংসারের অনেক কাজে। ব্যাঙ্কে জমা বাকি ৩০০ টাকা এবং তার সুদ জমা পড়ে দু’টি তহবিলে। একটি স্থায়ী, অন্যটি অস্থায়ী।
তহবিলের ওই টাকায় কী করা হয়? ভ্যানচালকেরা জানালেন, অস্থায়ী তহবিল থেকে প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পুজো, গানের উৎসবের আয়োজন করা হয়। খিচুড়ি ভোগ খাওয়ানো হয় সবাইকে। পুজোর পরে সপরিবার চড়ুইভাতি। বছরে অন্তত এক বার শহর থেকে দূরে কোথাও ঘুরে আসা। মাইথন, তারাপীঠ, বক্রেশ্বর, মুকুটমণিপুর, হাজারদুয়ারির মতো জায়গা ইতিমধ্যেই ঘুরে আসা গিয়েছে। এ বার তাই পুজোর পরে পুরী যাওয়ার পরিকল্পনা। তবে স্থায়ী তহবিলের টাকা খরচ করা হয় জরুরি প্রয়োজনে। ভ্যানচালকদের পরিবারে কারও অসুখ, মৃত্যু বা মেয়ের বিয়ের সময়ে ওই তহবিল থেকে বিনা সুদে ঋণ নিতে পারেন সদস্যেরা। সমবায় ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান আশুতোষ মণ্ডল বলেন, “ওঁরা আমাদের ব্যাঙ্কে টাকা রাখছেন। এটা ভাল উদ্যোগ।”
কী ভাবে চলছে ওই সমবায়? ভ্যানচালকেরা জানান, ব্যাঙ্কে রাখা টাকার হিসেব রাখেন তাঁরাই। তাতে গরমিল হয়নি কখনওই। এই প্রয়াসে খুশি অর্পিতা হালদার, শিপ্রা সরকার, রাবেয়া বিবিরা। স্ট্যান্ডে রিকশা টানেন তাঁদেরই স্বামীরা। ওই মহিলারা বলেন, “দিনভর ভ্যান চালিয়ে অনেক রাতেই নেশা করে বাড়ি ফিরত ওরা। একটা পয়সাও পকেটে থাকত না। সংসারের জন্য টাকা চাইতে গেলে গালিগালাজ, মারধর জুটত। এখন সে দিন নেই।” ‘বদলে যাওয়া’ এই মানসিকতাই ওই ভ্যানচালকদের নিয়ে গিয়েছে আয়লা-দুর্গতদের কাছে। দুর্ঘটনায় কেউ আহত হলে ওঁরা ভর্তি করেন হাসপাতালে। কিছু এলাকায় ডেঙ্গির প্রকোপ রুখতে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে জমা জল সাফ করে ওষুধও ছিটিয়েছেন তাঁরা। বিশ্বকর্মা পুজোর শিবিরে রক্তদান করেছেন। গরমের রক্তসঙ্কটে কলকাতার হাসপাতালে সপ্তাহে-সপ্তাহে গিয়ে রক্তদান করে গিয়েছেন।
দিনবদলের অভিজ্ঞতার কথা নিজেরাই শুনিয়েছেন। আচমকা বাবার মৃত্যুতে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছিলেন ভ্যানচালক রবীন দাস। সেই বিপদে তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেন সহকর্মীরা। বছরভর ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন ২০ টাকা করে ব্যাঙ্কে রাখতেন রবীনবাবু। বিনা সুদের সেই ঋণ শোধ হল এক বছরেই। ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান রবি সরকারও। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল তাঁর। এ ক্ষেত্রেও তা জোগান অন্য ভ্যানচালকেরাই।
আনকোরা এই উদ্যোগ নজর কেড়েছে অনেকের। স্থানীয় বিধায়ক চিরঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, “এর চেয়ে ভাল কাজ হতে পারে না।’’ ভ্যানচালকদের আয়োজিত গান-উৎসবে এসে শান্তিনিকেতনের বাউল তরুণ ক্ষ্যাপা বলেন, “দেশ-বিদেশে অনেক জায়গায় গিয়েছি। এমন জিনিস দেখিনি।” সমাজের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজেও এই ভ্যানচালকেরা যুক্ত হতে পারেন বলে মনে করেন উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল।
স্বল্প সঞ্চয়ে যে জীবন বদলাতে পারে সে কথা বুঝেছেন ওই ভ্যানচালকেরা।
এখন তাঁদের চোখে এক নতুন স্বপ্ন। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁদের মতো মানুষের কাছে এ কথা পৌঁছে দেওয়ার! |
|
|
|
|
|