|
|
|
|
গুণিজনদের পরামর্শ নিয়ে নাটক |
অনল আবেদিন • বহরমপুর |
কলকাতার নাট্যদলগুলির মতোই নতুন প্রযোজনার ‘ক্লোজড ডোর শো’ করে গুণিজনদের মতামত নিল বহরমপুরের ঋত্বিক। তাদের নতুন নাটক ‘জাগরণ পালা’ বিষয়ে ও আঙ্গিকে পরীক্ষামূলক। সেই পরীক্ষায় তাঁরা জড়িয়ে নিলেন শহরের নাট্যপ্রেমী বিদগ্ধজনদেরও। তাঁদের সেই ‘ক্লোজড ডোর শো’-তে দর্শক তালিকায় ছিলেন লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট দুই গবেষক শক্তিনাথ ঝা ও পুলকেন্দু সিংহ, রবীন্দ্রগবেষক তথা অবসরপ্রাপ্ত অধাপক মৃণালকান্তি চক্রবর্তী, গল্পকার সন্দীপন মজুমদার, ‘ছান্দিক’ ও ‘যুগাগ্নি’ নাট্যগোষ্ঠীর যথাক্রমে শক্তিনাথ ভট্টাচার্য ও অনুপম ভট্টাচার্য, লালগোলার শিক্ষক ও চিত্রকর জাহাঙ্গির মিঞা-সহ অনেকে। ‘ঋত্বিক’-এর সম্পাদক মোহিতবন্ধু অধিকারী বলেন, “প্রযোজনাকে আরও সফল ও সার্থক করে তুলতে বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন মতের ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুণিজনদের মতামত ভীষণ জরুরি। সেই তাগিদ থেকেই নিজস্ব ঘরনার চৌহদ্দি ভাঙার এই প্রয়াস।”
‘মনসামঙ্গল’ নিয়ে সেই কবে শম্ভু মিত্র করেছেন ‘চাঁদ বণিকের পালা’। ওই পালায় দুঃখ, কান্না, বিশ্বাস, প্রত্যয় ও অপত্য স্নেহ-সহ যাবতীয় অনুভব ও অভিব্যক্তির কেন্দ্রস্থল চাঁদ বেনে। কিন্তু বেহুলাকে নিয়ে সেভাবে কোনও নাট্যপ্রয়াস চোখে পড়েনি। কৌশিক রায়চৌধুরীর লেখা জাগরণ পালায় সেই বেহুলাই নায়িকা। ‘জাগরণ পালা’র আখ্যানভাগে রয়েছে, বিশল্যকরণীর মতো স্রেফ প্রেম আর বৈধব্য সম্বল করে স্বামীর শবদেহ বুকে আঁকড়ে দীর্ঘ জলপথ পাড়ি কিশোরী বেহুলার অশেষ লাঞ্ছনার কথা। দীর্ঘ যাত্রাপথে বেহুলাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে কামাতুর পুরুষ থেকে যৌনলালসায় বুঁদ হয়ে থাকা স্বর্গের দেবতাদের সঙ্গেও। অবশেষে সব বাধা জয় করে স্বামী লখিন্দর-সহ চাঁদ সওদাগরের মৃত ছয় পুত্রের জীবন ফিরিয়েছেন বেহুলা। ফিরে পেয়েছেন সপ্তডিঙা। সপ্তডিঙা আর সওদাগরের ছেলেদের নিয়ে শ্বশুরকুলে ফিরলেন বটে বেহুলা। কিন্তু জয় করতে পারলেন না পুরুষতন্ত্র। সমাজপতি, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি স্বামী লখিন্দরও বেহুলার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পুরুষতন্ত্রের নগ্ন চেহারা দেখে জীবনের সব মানে হারিয়ে ফেলা ক্লান্ত-বিধস্ত বেহুলা আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
কোন মুন্সিয়ানায় প্রিয়াঙ্কুশেখর দাসের নেতৃত্বে ওই প্রাচীনতম পালা এ কালের নারীরও জীবন-যন্ত্রণার জীবন্ত আখ্যানের রূপান্তরিত করল ‘ঋত্বিক’?
শক্তিনাথবাবু বলেন, “সংসারের জন্য যে কিশোরী বধূ সর্বস্ব দিল সেই সংসার তাকে নিল না। সুপ্রাচীন মনসামঙ্গলের ওই অভিনব ভার্সান আজকের সভ্য-আধুনিক কালের নারীর জীবনেও সমান সত্য। ওই সত্য যে মুন্সিয়ানায় তুলে ধরেছেন বেহুলা অর্থাৎ ঝুলন ভট্টাচার্য তা অসাধারণ।” পুলকেন্দুবাবু বলেন, “এর আগেও পুরাণ ও লোকগাথা আশ্রিত বহু নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। সে সব ক্ষেত্রে কোথাও চড়া সুরে রাজনীতির কথা বলা হয়েছে, কোথাও কাহিনিকে অহেতুক টেনে বড় করা হয়েছে। ‘জাগরণ পালা’ সে সব থেকে মুক্ত ও সুন্দর।” সন্দীপনবাবু, মৃণালবাবু প্রশংসা করেন, ‘অভিনয় থেকে সরে গিয়ে কথকতা, ফের কথকতা থেকে সরে গিয়ে অভিনয় করার’ মতো আঙ্গিকের সফল প্রয়োগের। সন্দীপন বলেন, “মঙ্গলকাব্যের ছন্দের সঙ্গে অমিতাক্ষর ছন্দ মিলেমিশে হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি একাকার হয়ে গিয়েছে ওই নাটকে, পটচিত্রের ব্যবহারও অন্য মাত্রায় উন্নীত করেছে নাটকটিকে।”
তবে ণালবাবু ও পুলকেন্দুবাবু-সহ অনেকের মতে, সমকালীন করার ঝোঁকে নাটকের দ্বিতীয় পর্বে নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহের নারী পাচার, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন প্রসঙ্গটি ‘তেলে জলে মিশ না খাওয়া’র মতো ‘আরোপিত’ হয়ে গিয়েছে। |
|
|
|
|
|