রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি এত দিনে সার্থক। সেই কবে তিনি গাহিয়াছিলেন, ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে’। বাঙালি সে গান গাহিয়াছে, শুনিয়াছে, কিন্তু হৃদয়ঙ্গম করে নাই। বাঙালি ভাবিয়াছে, কবি বুঝি কোনও অতীন্দ্রিয় ভাবের কথা বলিতে চাহিয়াছিলেন, এ গান বুঝি গভীর জীবনদর্শনের উচ্চারণ। বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে মনীষী বানাইয়া তাঁহার এমন অনেক বিড়ম্বনাই করিয়াছে, তাঁহার অনেক সহজ সরল কথাকেই যথাযথ স্বাভাবিকতায় গ্রহণ করিতে পারে নাই, তাঁহাকে ব্যর্থ নমস্কারে পূজা করিয়াছে, তাঁহার মানুষী আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকিয়া গিয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালি, কিন্তু স্ব-তন্ত্র। তিনি সহজ কথা সহজ ভাবে বোঝেন। অতএব তিনি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে বাইশে শ্রাবণ ছুটি দিয়াছিলেন। কবির বিদায়-দিনে উহাই ছিল তাঁহার নিমন্ত্রণ, ছুটির নিমন্ত্রণ। কিন্তু স্বতন্ত্র হইতে পারেন, মুখ্যমন্ত্রী তো বাঙালিও! এক দিন ছুটি দিয়া তাঁহার মন ভরিবে কেন? পারিলে, অন্তত সার্ধশত দিন তিনি ছুটির বন্দোবস্ত করিতেন। পারেন নাই। সর্বশক্তিমতীরও সীমিত সামর্থ্য। কিন্তু তিনি বাঙালিকে টানা দশ দিন, কার্যত এগারো দিন পূজার ছুটি দিয়াছেন। ‘আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে’ বলিয়া খেদ করিবার কোনও সুযোগ আর থাকিল না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়া থাকেন, তিনি কাজ ভালবাসেন। তিনি সত্যই পরিশ্রমী। এ বিষয়েও তিনি রবীন্দ্রনাথের যোগ্য শিষ্যা। কবিও কাজ ভালবাসিতেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্ভবত ছুটি আরও ভালবাসেন। ছুটি লইতে নয়, ছুটি দিতে। তাঁহার জীবনের লক্ষ্য হয়তো ইহাই যে, তিনি কাজ করিবেন, তাঁহার প্রজারা ছুটি ভোগ করিবেন। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, ‘ওরা কাজ করে’। মুখ্যমন্ত্রী হয়তো লিখিবেন, ‘আমি কাজ করি’। তাঁহার সদয় প্রাণটি হয়তো রাজ্যবাসীকে পূজার ছুটি দিয়া উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছে। তবে কিনা, তিনি নিজেকে একটি প্রশ্ন করিয়া দেখিতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গে তো এমনিতেই কাজ বিশেষ হয় না, যাহা হইত, তাহাও তিনি নানা উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা করিয়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন, এখন পূজার অবকাশটিও প্রলম্বিত হইল। তাহা হইলে মা মাটি মানুষের উন্নতি কি সম্পূর্ণতই স্বপ্নে ঘটিবে?
এ প্রশ্ন অ-বাঙালি প্রশ্ন। বাঙালি তাহার মুখ্যমন্ত্রীকে মাথায় তুলিয়া রাখিবে। বাঙালি এ বার পূজায় দ্বাদশীর দিনটি লইয়া মহাসঙ্কটে পড়িয়াছিল, ওই একটি দিন কাজ করিলে দীর্ঘ অবকাশ বিপন্ন হয়, আবার কাজ না করিলে ছুটি মারা যায়। মুখ্যমন্ত্রী সেই সঙ্কট মোচন করিয়া দিয়াছেন, অতঃপর বঙ্গজন নিশ্চয়ই মনে মনে হাল্লার রাজার ন্যায় ‘ছুটি’ ‘ছুটি’ বলিয়া লাফাইতে লাফাইতে বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। এমন আনন্দের মরসুমে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয়ের জন্য দুঃখ নয়। বেচারি পূজার ছুটি কমাইবার একটি প্রাথমিক উদ্যোগ করিয়াছিলেন, ছুটি কমাইয়াছিলেনও। সেই দিনই বাঙালির অভিশাপ তাঁহার গদিতে লাগিয়াছিল, মহাকরণ হাতছাড়া হইয়াছে। বাঙালি এখন তাহার যোগ্য নায়িকা পাইয়াছে। বাঙালি জানেও না, আসলে তাহার ছুটি হইয়া গিয়াছে। |