সম্পাদকীয় ১...
শেষের সে দিন
রিবর্তন সত্য না মিথ্যা, তাহা লইয়া অনেক কথা আদিগঙ্গা ওরফে টালির নালা দিয়া বহিয়া গিয়াছে। এক অর্থে, এই রাজ্যে পরিবর্তন পতাকামাত্র সার, দুই জমানার তফাত আদিগঙ্গা এবং টালির নালার তফাতের মতোই। কিন্তু প্রকৃত পরিবর্তন অনেক সময়েই গভীরতর, সুতরাং দুর্নিরীক্ষ্য। গভীর জলের মাছের মতো ক্বচিৎ সেই পরিবর্তনের সঙ্কেত পাওয়া যায় হেমিংওয়ের উপন্যাসে বৃদ্ধ মৎস্যজীবীর অভিজ্ঞতা স্মরণীয়। জঙ্গিপুর উপনির্বাচনের পরিণাম তেমনই এক সঙ্কেত। নির্বাচিত প্রার্থী দুই আঙুলে যে বিজয়চিহ্ন দেখাইয়াছেন, তাহাতে পাটিগণিতের সান্ত্বনার অধিক কিছু নাই। সি পি আই এমের ‘গৌরবময়’ পরাজয় তথা এব চ। কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের কণ্টকাকীর্ণ সওয়াল-জবাবও প্রত্যাশিত ছিল সম্প্রতি-বিচ্ছিন্ন দম্পতির আলাপ সচরাচর মধুর হয় না। কিন্তু অন্তরালে? একটি উপনির্বাচনের ফলাফল হইতে কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের প্রশ্ন নাই, কিন্তু বৃহত্তর রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সঙ্কেতটিকে বিচার করিলে আশঙ্কা হয়, ছিপে যে টানটি পড়িতেছে তাহার উৎস অবস্থানে গভীর এবং আয়তনে বৃহৎ।
সঙ্কেত একটি নয়, দুইটি। এক, ভারতীয় জনতা পার্টির দশ শতাংশের বেশি ভোট প্রাপ্তি। দুই, ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া এবং সোশাল ডিমক্র্যাটিক পার্টি অব ইন্ডিয়ার মতো দুইটি দলের সংগৃহীত সম্মিলিত প্রায় আট শতাংশ ভোট। পশ্চিমবঙ্গে এমন ঘটনা সুলভ নয়। জঙ্গিপুরের বিশেষ জনবিন্যাস বা এই উপনির্বাচনের বিশেষ পরিস্থিতির অ-সাধারণত্ব দিয়া এই ফলাফলের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করিতে চাহিলে ভুল হইবে। প্রথমত, ভারতীয় জনতা পার্টির জনসমর্থনে বিপুল বৃদ্ধিতে সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রতিফলন অনস্বীকার্য। কার্যত দেশ জুড়িয়া কংগ্রেসের সমর্থন নিম্নগামী, বিজেপির ঊর্ধ্বগামী, উত্তরাখণ্ডেও তাহারই আর এক প্রমাণ মিলিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় রাজনীতিতে প্রান্তিক হইতে পারে, বিচ্ছিন্ন নিশ্চয়ই নয়। অনুমান করা যায়, আগামী লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের অন্যত্রও এই প্রবণতা অল্পবিস্তর প্রতিফলিত হইবে। দ্বিতীয়ত, দুইটি সংখ্যালঘু-কেন্দ্রিক দলের সাফল্য সঙ্কেত দেয়, পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের দলের রাজনীতি হয়তো ক্রমে গ্রহণীয় হইয়া উঠিতেছে। এবং, তাহা যদি সত্য হয়, তবে বিজেপি’র মতো দলের সাফল্যের সম্ভাবনাও বাড়িয়া যাইবে। সহজ কথায় বলিলে, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরুর দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির প্রতিপত্তি যদি বাড়ে, তবে বুঝিতে হইবে, জঙ্গিপুরের সঙ্কেত অর্থহীন নয়।
এবং মানিতে হইবে, পরিবর্তন গভীর এবং মৌলিক। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস এবং বামপন্থী দলগুলি উভয়েই আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা পরিচিতি-নির্ভর রাজনীতিকে অন্তত সরাসরি অবলম্বন করে নাই, এক ধরনের সর্বজনীন মঞ্চে স্থিত থাকিয়াছে কংগ্রেস তো তাহার ‘প্ল্যাটফর্ম’-এই, আর সি পি আই এমও ভোটের তাড়নায় আপন ‘শ্রেণিচরিত্র’কে ক্রমাগত শোধন করিয়া লইয়াছে। এই রাজ্যের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণটিও এই সর্বজনীনতার অনুগামী। পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ও রাজনীতিতে ধর্মীয় বা অন্য পরিচিতির ভূমিকা কোনও দিনই সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ছিল না, কিন্তু তাহা রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হইতে পারে নাই। অধুনা বিভিন্ন ধরনের পরিচিতিনির্ভর গোষ্ঠীকে গোষ্ঠী হিসাবে আপন রাজনীতির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিবার উদ্যোগ বাড়িতেছে। বিশেষত, মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন নীতি ও প্রচারে সংখ্যালঘুকে ভোটব্যাঙ্কে পরিণত করিবার চেষ্টা প্রকট। এই প্রবণতাই আবার সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগকে প্রবলতর করিয়া সংখ্যাগুরুর রাজনীতিতে প্রবল ইন্ধন জোগাইতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাস ও সামাজিক কাঠামো যে রূপ, তাহাতে আশঙ্কা হয়, এই ধারাকে প্রশ্রয় দিলে তাহা দ্রুত ভয়ানক আকার ধারণ করিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের কর্তব্য ছিল, ক্ষুদ্র হইতে বৃহৎ বাঙালির সাধনায় মনপ্রাণ নিয়োজিত করা, বিভাজন হইতে মিলনের পথে অগ্রসর হওয়া। যে পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাইতেছে, তাহা সম্পূর্ণ বিপরীত। জঙ্গিপুর যদি সত্যই দিনের শুরু হয়, তবে শেষের সে দিন সত্যই ভয়ঙ্কর।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.