ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে বলে পরিচিত মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য নয়ের দশকের গোড়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন মোহনবাগানে। মোহনবাগানের ঘরের ছেলে সুব্রত ভট্টাচার্য গত দশকেই কোচ হিসেবে যোগ দেন চির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবে। কলকাতার পুজোতেও এমন ঘরের ছেলে কথাটি চালু হয়ে গিয়েছে। গত কয়েক বছরে পুজোর প্রথম সারির শিল্পীদের অনেকেই বিভিন্ন ক্লাবের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিলেন। এ বার অবশ্য মনোরঞ্জন-সুব্রতর মতোই পুজো ময়দানের ‘ঘরের ছেলেরা’ পাল্লা দিয়ে ঘর ছেড়ে পরবাসে পাড়ি দিচ্ছেন। আবার দু’-এক জন ধীরে ধীরে ঘরের ছেলে হয়ে উঠছেন শহরের পুজোগুলিতে।
থিম পুজোর অন্যতম স্রষ্টা শিল্পী অমর সরকার। এক সময়ে বেহালা এলাকা থেকে এক সহশিল্পীর সঙ্গে জুটি বেঁধে শহরকে থিম পুজো চিনিয়েছিলেন তিনি। অমর এ বার রয়েছেন চার-চারটি পুজোর দায়িত্বে। যার মধ্যে হিন্দুস্থান পার্ক ও টালা বারোয়ারিতে গত বারও কাজ করেছিলেন তিনি। এ বছর টালা বারোয়ারিতে তিনি থিম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ‘ঝুলন’কে। ছোট্টবেলার পুতুল-ঘাস-পাতা দিয়ে সাজানো ‘মায়া-নগরী’ এ বার তুলে ধরছেন সেখানে। হিন্দুস্থান পার্কে অমরের থিমের মূল ভাবনা ‘ভয়’। শিল্পী বলছেন, “অজানা, অতিপ্রাকৃত জিনিস থেকেই ভয়ের উৎপত্তি। তাই মানুষ এমন এক শক্তিকে খোঁজে, যা দিয়ে ভয়কে জয় করা যায়। সেই শক্তিই হলেন দুর্গা।” বেহালা নতুন দলে গত বার ছিলেন রণো বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার সেখানে অমর তুলে ধরছেন ‘পুষ্পবৃষ্টি’কে। |
জোরকদমে কাজ চলছে গড়িয়াহাট এলাকার এক মণ্ডপে। রবিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিকে দেবীর সামনে আরতিকেই বেছে নিয়েছেন থিম হিসেবে।
থিম পুজোর শুরু থেকেই দর্শকদের আকর্ষণের জায়গা ভবতোষ সুতার। গত বার নাকতলা উদয়নে কাঠ ও ধাতুর মূর্তি গড়ে চমকে দিয়েছিলেন। এ বার সেই ‘ঘর’ বদল না করলেও লেকটাউন ও দমদম পার্কের দু’টি পুজো থেকে সরে এসেছেন তিনি। দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন তিনটি পুজোর শিকদারবাগান, বেহালা বন্ধুশ্রী ও চেতলা অগ্রণীর। ভবতোষ এ বারই প্রথম সাবেক উত্তর কলকাতায় কাজ করছেন। বৈশাখের শুরুতেই হাতিবাগানের শিকদারবাগান ফ্লেক্সে ভবতোষের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। শিকদারবাগানের পুজোর শতবর্ষে ভবতোষ সেখানে নানা ধরনের দাঁড়িপাল্লায় মণ্ডপ সাজাচ্ছেন। প্রতিমার সঙ্গে থাকছে থার্মোকলের কারুকাজ। নাকতলা উদয়নে ‘প্রজাপতি’কে থিম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। চেতলা অগ্রণীতেও ‘হৃদয় প্রেমের শিষ্য’-এর থিম গড়ছেন। বন্ধুশ্রীতে ভবতোষের সঙ্গে নির্মল মালিক-সহ কয়েক জন বন্ধু কাজ করছেন। সেখানে থিম হিসেবে রয়েছে ‘রিকশা’। রিকশার সঙ্গে বাঙালির জীবনের নানা পর্যায় ও স্মৃতিকে তুলে ধরছেন তাঁরা।
গত কয়েক বছর উত্তরের নলিন সরকার স্ট্রিটের ‘ঘরের ছেলে’ হয়ে গিয়েছিলেন সনাতন দিন্দা। এ বার ঘর ছেড়ে বড়িশার ‘পরবাসে’ পাড়ি দিয়েছেন। বড়িশা ক্লাবে তাঁর থিম শ্রদ্ধা। একই সঙ্গে কাজ করছেন দক্ষিণ কলকাতার ৯৫ পল্লিতেও। সেখানে অসুর বধের পরে দেবীর আনন্দের রূপ ফুটিয়েছেন তিনি। মণ্ডপ হচ্ছে নাট্যমঞ্চের আদলে। থাকছে রং ও আলোর খেলা।
শিল্পী মহলে মাটির মানুষ বলে পরিচিত দীপক ঘোষ পরপর তিন বছর ‘হ্যাটট্রিকের’ পরে এ বার ছেড়ে এসেছেন ত্রিধারা সম্মিলনীকে। এ বছর তাঁর কাজ দেখা যাবে লেক গার্ডেন্স পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশন, দেশপ্রিয় পার্ক ও বালিগঞ্জ পূর্বপল্লিতে। লেক গার্ডেন্সে তিনি তুলে এনেছেন কেরলের ‘কলামণ্ডলম’। তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতীকে। দেশপ্রিয় পার্কে থার্মোকল ও ওষধি গাছের সমন্বয়ে অমরাবতী নন্দন কানন ও ইন্দ্রের প্রাসাদ গড়ছেন তিনি। বালিগঞ্জ পূর্বপল্লিতে নতুন একটি থিম দিয়েছেন দীপকবাবু। সেখানে শিল্পীদের কারিগরদের কর্মশালাকে তুলে ধরা হচ্ছে। বলছেন, “শিল্পীদের আলোয় কারিগরেরা হারিয়ে যায়। অথচ আমাদের সাফল্য ওঁদের উপরে অনেকটা নির্ভর করে। তাই কারিগরদের সম্মান জানাতে এ থিম।”
দল বদলের খেলায় অবশ্য ঘরের ছেলে হিসেবেই রয়ে গিয়েছেন সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। গত কয়েক বছর ধরে নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘ ও লেক টেম্পল রোডের শিবমন্দিরের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছেন তিনি। সুরুচির থিম এ বার ‘গোয়া ও সমুদ্র দূষণ’। নারকেল মালা, সমুদ্র ফেনার পাশাপাশি গোয়ার ডটেড প্রিন্ট কাজ দেখা যাবে সেখানে। শিবমন্দিরে মানব ক্লোনের বিরোধিতাকে তুলে ধরেছেন সুব্রত। সঙ্গে এ বার তাঁর হাতে রয়েছে ট্যাংরা ঘোলপাড়া। সেখানে কুণ্ডলিনী শক্তির বিকাশকে থিম হিসেবে বেছেছেন তিনি।
অন্য শিল্পীরা যখন ‘ঘর’ বদলে দর বাড়িয়েছিলেন, তখনও টানা বছর ছয়েক কসবা তালবাগানে কাজ করেছেন প্রশান্ত পাল। এ বার কিন্ত তাঁর দল-বদলের পালা। এ বছর প্রশান্তের কাজ দেখা যাবে তিনটি পুজোয়। আহিরীটোলা সর্বজনীন, দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘ ও বেঙ্গল ইউনাইটেডে। আহিরীটোলায় প্রশান্ত তুলে ধরছেন চিনের ড্রাগন উৎসবকে। দমদম পার্ককে তিনি থিম দিয়েছেন ‘রং-উৎসব-দুর্গা-সৃষ্টি-মিলন’। এই পাঁচ শব্দের বন্ধনীতে সেখানে উৎসবের আমেজ ফুটিয়ে তুলবেন তিনি। বেঙ্গল ইউনাইটেডে শৈশবকে যৌবনের চোখে ফুটিয়ে তুলবেন প্রশান্ত।
গত বছরের বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘ ছেড়ে এ বার পূর্ণেন্দু দে কাজ করছেন সন্তোষপুর লেক পল্লি ও রাজডাঙা নবোদয়-এ। সন্তোষপুরে মেহগনি, কদম, শিরিষ কাঠ ও পিতলের চাদর দিয়ে মণ্ডপ গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রতিমা হচ্ছে পুরনো দিনের মূর্তির আদলে। শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে দেবীর হাতে অস্ত্রের বদলে থাকছে পদ্মফুল। পুজো কমিটির আশা, পূর্ণেন্দু হাতের কাজ দেখতে এ বার লোকের ঢল নামবে এই পুজোয়। রাজডাঙা নবোদয়ের পুজোয় থিম হিসেবে বাছা হয়েছে রং ও রেখা। দেখা মিলবে চেরা বাঁশের কাজের-ও।
পুজো ময়দানের প্রথম সারির শিল্পী সুশান্ত পাল এ বার তিনটি পুজোর দায়িত্বে। গত বারের মতো খিদিরপুর পল্লি শারদীয়ায় রয়েছেন তিনি। সেখানে তুলে ধরছেন দেবী ত্রিভুবনেশ্বরীকে। থাকছে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের তিন স্তর। নেতাজি জাতীয় সেবাদলে তিনি গড়ছেন দুর্গার সৃষ্টির নানা রূপ। মুদিয়ালিতে সুশান্ত থিম বেছেছেন সাবেকিয়ানা। আলাদা কোনও থিম নয়, প্রতিমাই মূল আকর্ষণ সেখানে।
আজ, সোমবার দেবীপক্ষ। পুজোর ফাইনাল কাউন্টডাউনে এসে রীতিমতো তাল ঠুকছেন প্রথম সারির শিল্পীরা। তবে নিশ্চিন্ত নন। উৎসব কাপের লড়াইয়ে প্রথম সারিদের কড়া চ্যালেঞ্জ জানাতে আস্তিন গুটিয়ে তৈরি পুজো-শিল্পের উঠতি তারকারাও। |