|
|
|
|
|
|
|
আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য |
সকাল সাড়ে দশটায় পৌঁছে শোনা গেল, উনি এখনও ঘুমোচ্ছেন। বোঝা গেল, ঢেঁকি স্বর্গে গিয়ে অ্যালার্ম দেয় না। বারোটা নাগাদ, হাতে ধোঁয়াওঠা কফি, মুখে বিরক্তি, বডিতে ঔদ্ধত্য নিয়ে প্রবেশ। ডিজাইনার জোব্বা। রূপের ছটায় ভাল করে তাকানো যাচ্ছে না। পারফিউমের মতো, অলৌকিক সাফল্যের অহং ঘিরে আছে।
প্রতিবেদক: স্যর, আপনি এত বেলা অবধি ঘুমোচ্ছেন!
রবীন্দ্রনাথ: জেগে বসে থাকলেই নোবেল মেডেলটার কথা মনে পড়ে যায়। চোখ বুজে থাকা তেত্তিরিশ গুণ বেটার।
প্রতি: আপনার দেড়শো বছর নিয়ে কী ঢক্কানিনাদ জানেন তো?
রবি: সমস্ত জানি। বেছে বেছে আমার বস্তাপচা নাটকগুলোকে রিভাইভ করা হচ্ছে, থার্ডক্লাস উপন্যাস নিয়ে আঁতেল পরিচালক ফোর্থক্লাস ফিল্ম বানাচ্ছে, পালে পালে গাইগাধা গলা কাঁপিয়ে বিল্লিবিলাপের থিমে আমার গানগুলোকে নর্দমায় চোবাচ্ছে। উফ, এই শালার গান কী মরতে যে বানাতে গেছিলাম! সিরিয়ালে কোন মেয়ের নতুন ব্রণ গজাল কি কোন মিস্তিরি শ্রাদ্ধের ম্যারাপ বাঁধতে শুরু করল, ব্যস, ব্যকগ্রাউন্ডে জমজমিয়ে রোবিন্দোসংগীত। হাই-কলচর স্প্রিন্ট টানছে। আর, কোন লেভেলের আস্পদ্দা, তোরা ট্রাফিক সিগন্যালে আমার গান বাজাচ্ছিস! ন্যাংটো নাচে সংস্কৃত স্তোত্র, অ্যাঁ? যা সবচেয়ে নির্জন, অপূর্ব একা, পবিত্র আর নিবিড় জলফোঁটা, তাকে নড়া ধরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে গুষ্টির পিন্ডির মধ্যে নিয়ে গিয়ে, হর্নের গজল্লা, চা-দোকানের কচালি, হকারের হুংকার, পথচারীর খিস্তি, ট্রাফিক পুলিশের বাঁশি, বাসের বাইসেপবাজি, অটোর অশ্লীলতা, অফিসটাইমের লাথি, থ্যাবলা থুতু, গুটখার ছোপের মধ্যে ফেলে ভাল্লো করে তার মুখটা ঘষটে রগড় দেখছিস? এটা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন? তো ধর্ষণ কাকে বলে?
প্রতি: স্যর, স্যর, আমাদের ইচ্ছেটা কিন্তু সৎ!
রবি: তাতে কী? সৎ ছাগলছানাকে নোবেল কমিটির ভাষণ দিতে স্টেজে তোলা যায়?
আর, আমায় নির্বোধ ভাবিসনি। সারা দিন ছম্মকছাল্লু আইটেম নাম্বার চেখে লাল ফেলতে ফেলতে তোরা হঠাৎ আমার প্রেমে পাগলা হয়ে রবীন্দ্রসমুদ্রে ছপছপাচ্ছিস, এ টুপি অন্যকে গিয়ে পরা। আমার এত ডিম্যান্ড, তার মেন কারণ: প্রোপাজালে রবীন্দ্রনাথ দেখাতে পারলে ফান্ড আসে। সরকার মাল্লু ছাড়ে। কাল থেকে আমার ব্যাপারটায় টোটাল পয়সা বন্ধ করে কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কাব্য-প্রোমোশনে কোটি কোটি টাকা ফান্ডের ব্যবস্থা কর, দ্যাখ রাতারাতি এই শালা বাঙালি আঁতেলগুচ্ছ আমায় ঠাটিয়ে রদ্দা মেরে ‘জয় কুমুদ’ বলে অডিটোরিয়ামের কার্পেটে ক্যায়সা ডাইভ খায়।
প্রতি: ওরম বলবেন না স্যর, আপনাকে আমরা কত্ত ভালবাসি, আপনার ছেলের বিবাহ-বহির্ভূত কেচ্ছা নিয়ে অবধি বেস্টসেলার তৈরি হচ্ছে!
রবি: আমার কেচ্ছা নিয়েও হচ্ছে! আমি আমার বউদির সঙ্গে শুয়েছিলাম কি শুইনি, শুলে কতটা শুয়েছি এবং বাকিটা কেন পারিনি, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-র স্তন ধরে কী বলেছি এবং কতটা পজ দেওয়া উচিত ছিল, সব নিয়েই পণ্ডিতরা কাসুন্দি প্যাক করে বাজারে ছাড়ছেন। বাঙালির তো এটাই ক্যালি, হলুদ মলাট না পড়ে সে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির ডোজ রবীন্দ্র-সম্পর্কিত প্রবন্ধ থেকে চাটবে, আর নিজের পাছা চাপড়ে বলবে, ‘মনস্ক পাঠক’! এ বার আমার গোটা বংশের কে কবে জোড়াসাঁকো বাড়ির কোন থামের আড়ালে কোন অবৈধ ডবকাকে ফ্রেঞ্চ কিস করেছিল তা নিয়ে ডিপ-থটের যাত্রাপালা এল বলে!
প্রতি: আপনার ভাষা কিন্তু এট্টু চেঞ্জ করে গেছে।
রবি: তার কারণ কানের গোড়ায় মধু আর কানের গোড়ায় থাবড়ার ভাষা এক হয় না বাপ। তোরা ভদ্র মনোযোগী শ্রদ্ধাবান জাত থেকে নর্দমার কিড়ে-মকোড়ে’তে চেঞ্জ করে গেছিস, টাকাকে জীবনের মধ্যিখানে প্রতিষ্ঠা করে তার সহস্র চটি ওপ্নলি চাটছিস, সে খেয়াল আছে?
প্রতি: এত রেগে যাচ্ছেন কেন, বিষয়টা বদলাই, বিরাট কোহলি নিয়ে কিছু বলবেন?
রবি: ক্কী!?!? |
|
রবীন্দ্রনাথ, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে। |
প্রতি: কারেন্ট টপিকের সবই তো দেখছি জানেন, তা একটু স্পোর্টস পেজ-এর জন্যেও বাইট...
রবি: এর পর তো রানি মুখাজ্জির নাইকুন্ডুলি নিয়ে রি-অ্যাকশন চাইবি রে! মিডিয়ার বেহায়া বিচ্ছুমি অ্যাদ্দূর! সব্বাইকে বাজারের সেম বেগুন ভাবিস! আজ আমায় কোহলি নিয়ে বলতে বলছিস, কাল ওকে আমায় নিয়ে বলতে বলবি!
প্রতি: সরি সর্রি স্যর, বরং আপনার লেখা ধনধান্যপুষ্প-টা নিয়ে একটা কমেন্ট দিন।
রবি: ফ্র্যাংকলি, এই ধারণাটা খারাপ লাগেনি যে, যা কিছু বিখ্যাত, সব আমার লেখা। ‘টুইংকল টুইংকল লিট্ল স্টার’ লিখেছি, তার পর ‘বুরি নজরওয়ালে তেরা মুহ্ কালা’। ক’দিন পরেই স্টেজে উঠে মন্ত্রীসান্ত্রী আবৃত্তি করবে: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের— ‘পাঁচি পাঁচ ছাগলের মা’!
প্রতি: আর মাইকেলের সভায় আপনার মুন্ডু!
রবি: এটাও ওই থিমেই: সব মহাপুরুষই আমি। মাতঙ্গিনী হাজরার সভাতেও না লাগিয়ে দেয়। তবে, এ বার অসুরের মুখগুলো ভাল করে স্টাডি করিস। দেড়শোর ঢেকুর তো, কে ট্রিবিউট হিসেবে গড়ে দিল। ওই পার্টির কয়েকটা পুজো-পান্ডা আছে না?
প্রতি: কিন্তু আগের পার্টিও তো...
রবি: সে আরেক্কাঠি! এই ‘বুর্জোয়া’ বলে খেউড় বাগাচ্ছে, ওই নজরুল আর সুকান্তর সঙ্গে আমায় এক তোরঙ্গে দুমড়ে ঠুসে থ্রি-ইন-ওয়ান ‘সন্ধ্যা’ নামাচ্ছে। অশিক্ষা আর নিতম্বপাকামির পাঞ্চ!
প্রতি: তাইলে স্যর? আপনিই তো বলেছিলেন, বাঙালির প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ...
রবি: ব্লান্ডার করেছিলুম ভাই। শেষ দিকটা আবছা আন্দাজ করছিলাম, অংকে জল মিশেছে, বিশ্বযুদ্ধ-ফুদ্ধ’য় পশুয়ানির অ্যাবসোলিউট জয় বুঝেও ঘাড় ঠ্যাঁটা করে মানুষজাতের মহত্ত্বের ম্যানিফেস্টো বিলোনো উচিত না, কিন্তু ওই বয়সে এসে আর ৩৬০ ডিগ্রি টুইস্ট খাওয়ার এনার্জি ছিল না। তা ছাড়া ইমেজের ইনার্শিয়া আছে তো! এক বার কমিট করে দিলে তখন ছক্কার জন্যে বল তুলতেই হবে।
প্রতি: এখন কী মনে হচ্ছে? ক্যাচ উঠে গেছে?
রবি: লোপ্পা। তোদের ইয়াং ব্রিগেডকে দ্যাখ না। হতভাগারা আমার একটা লাইনও পড়ে না, এ দিকে দাবড়ে অস্বীকার করার ধক-টাও নেই। ডেঁটে দাঁড়িয়ে বল, আমরা দিনমান টিভি গিলি, ফেসবুকে গাধামার্কা কমেন্ট লিখে ভাবি সাহিত্যকম্ম, হিসি করার সময়েও মোবাইল না দেখলে ফ্লো বন্ধ হয়ে যায়, ও সব বই পড়া-ফড়া উঠে গেছে বস, তোমার দিন গেছে, পথ দ্যাখো। তা হলেও বুঝি। তা না, আমার ছবি পোস্ট করছে আর আনতাবড়ি লাইক করছে। ইদিকে ‘রক্তকরবী’র ইংরিজি করবে ‘ব্লাডি ফুল’!
প্রতি: কিন্তু আর্টিসরা তো বিনয়ে অবনত স্যর।
রবি: ডবল অশান্তি! এই ম্যাদামারা নাতিপুতির ঝাঁক আমি চেয়েছিলাম? প্রকৃত শিল্পী হবে কলার-তোলা, তছনছিয়া। সে কোলকুঁজো স্টান্সে অন্যের চরণাম্মেতো সুড়ুক-সাড়ুক মেরে ধন্য হবে কেন? সিধে বল, ১৮৬১-র বান্দা দিয়ে আর ২০১২ রিপ্রেজেন্ট করা চলে না, আপাদমাথা নতুন ভাষায় নতুন কাণ্ড লিখব।
প্রতি: খেপে উঠবেন না?
রবি: স্যালুট ঠুকব রে! প্রকৃত আত্মসম্মানওলা সংস্কৃতিমান জাতের স্টেটমেন্ট তো ওইটাই হবে। নিজের ভাত নিজে মাখ। নিজের ম্যাপ নিজে আঁক। সেই দীক্ষাই চেষ্টা গিয়েছিলুম। তা না শালা আলখাল্লার খুঁট আঁকড়ে মিনমিনিয়ে ঝুলছে আর ভাবছে একটা ১৯১৩ ধরে সারা জীবন লুজার-প্যাঁক-পারাবার পেরিয়ে যাবে। বরং চোরটার দম আছে। এক রাতের লেবার দিয়ে নোবেল পেল তো! |
|
|
|
|
|