বাব্বা! এত দূর এসে এ রকম ব্যবহার পেতে হবে? ভাবতেই পারিনি। ছি ছি ছি, ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে তো কখনও মনে হয়নি যে এত অসভ্য। ‘তাই না তাই! অন্য সময় এমন ব্যবহার করে যেন একেবারে আদর্শ মেয়ে আদর্শ ছেলে।’ ‘গীতাদি দেওরের মেয়েদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অমন মেয়ে হয় না আজকালকার দিনে। এই তো তাদের ছিরি।’
বন্ধ দরজার এ পারে আমি, দিদি আর দাদা চুপ। ভীষণ হাসিও পাচ্ছে, আবার খুব লজ্জাও লাগছে। ছি ছি, কী করলাম আমরা। নিজেদের চরিত্রে পটাপট কালিমালেপন হচ্ছে জেনেও আটকানোর চেষ্টা করলাম না?
ঘটনাটা ঘটেছিল বিজয়া দশমীর দিন চারেক পরে। আমাদের বাড়ি এমনিতে, এবং অমনিতেও একটি হট্টমেলার ময়দান। একে জয়েন্ট ফ্যামিলি, তার ওপর রোজই আরও অনেক লোক জমায়েত হত বাড়িতে। কেউ কাছেই ব্যাঙ্কের কাজে, কেউ হরেক অ্যাডভাইস নিতে, কেউ জিনিস দিতে, কেউ নিছক কুশল খুঁজতে এ বাড়ি চলে আসত। আমাদের বাড়িতে তখন দিনে বার কুড়ি চা হত, অসময়ে ভাত বসত, সিনেমার টিকিট নষ্ট হত, আর রাত দুটো অবধি এঁটো হাতে আড্ডা হত।
এমন দেদার দরাজ বাড়ির তিন ছেলেমেয়ে দশমীর পর অতিথি এসেছে জেনেও দরজা খুলল না! বেল বাজল, ধড়াম ধড়াম দরজা ধাক্কানো হল, বাড়ির নীচে থেকে প্রাণপণ ভালনাম-ডাকনাম ধরে ডাকাডাকি হল, ভেতরে আমরা তিন ভাইবোন অবিচল। আবার এমন বোকা আমরা, কিছু ক্ষণ পর ঘর আর বারান্দার আলো নিবিয়ে দিয়ে ভাবলাম, ওরা মনে করবে আমরা বাড়ি নেই। এক বারও মনে হল না, বাইরের দরজায় তালা নেই, অতএব সবাই বুঝতে পারছে, ভেতরে লোক আছে। তার ওপর, বন্ধ দরজার এ-পারে দাঁড়িয়ে এমনই জোরসে ফিসফিস করলাম, সবাই বুঝল, আর কেউ না থাকুক, ছেলেমেয়েগুলো আছে।
হয়েছিল কী, আমার, দিদির বা দাদার কাছে তখন কোনও পয়সা ছিল না। দাদা তখনও বেকার, দিদি ইলেভেন আর আমি নাইন। মা-বাবারা সবাই বিভিন্ন জায়গায় বিজয়া করতে চলে গিয়েছিল, আর তার আগে আমাদের হাতে মিষ্টি-টিষ্টি কেনার জন্যে টাকাপয়সা দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিকেল থেকে এমন বেগে এবং এমন সংখ্যায় বিজয়া পার্টি আসতে শুরু করল, সব টাকাপয়সা সিঙাড়া-রসগোল্লায় শেষ। আমরা সম্পূর্ণ ফতুর। অথচ বড়রা শিক্ষা দিয়েছে যে বিজয়ার পরে এলে দুটো মিষ্টি খাওয়াতে হয়। এ বার তা হলে করি কী? দরজা খুলে অতিথি ডেকে মিষ্টি না-খাওয়ানোর অসভ্যতা, আর দরজা না-খোলার অসভ্যতা কোনটা বেশি লজ্জাকর, ভাবার সময় ছিল না। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে অসভ্য হওয়ার পন্থাটাই বেছে নিয়েছিলাম আমরা। একের পর এক বেল বাজে, আর আমরা আরও অসভ্য হই।
তার পর বড়রা বাড়ি ফিরে কী বকুনি দিল! বলল, এমন খারাপ, বোকা, বাড়ির সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়া ছেলেমেয়ে ওরা কস্মিন কালেও দেখেনি। আমাদের নাকি বলা উচিত ছিল, আমাদের কাছে পয়সা নেই, কেউ কিচ্ছু মনে করত না, হাসিমুখে আদর করে চলে যেত। এ বার সবাই ভাবল, এ বাড়ির শিক্ষাদীক্ষাভদ্রতা সমস্ত গোল্লায় গেছে। |