রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
সু ম না মি
৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সন্ধে। কয়েক জনকে নিয়ে একটা গাড়ি ছুটে চলেছে দক্ষিণ কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউ দিয়ে। এই গাড়ির সঙ্গে আর একটা গাড়ির ধাক্কা লাগল। একটি দরজা খুলে গেল সেই ধাক্কায়। দীর্ঘদেহী এক পুরুষ সেই দরজার ধারে বসে ছিলেন। তাঁর দেহটি সজোরে বেরিয়ে গেল বাইরে। একটা ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা মারল তাঁর মাথা, যা তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যস্ত ছিল লতাঙ্গি নামে একটি রাগ নিয়ে। সারাটা পথ গুনগুন করছিলেন তিনি রাগটি। পাশেই ছিলেন তাঁর ছাত্রী পূরবী মুখোপাধ্যায়। জানতে চেয়েছিলেন ওটা কোন রাগ। দীর্ঘদেহী মানুষটি বলেছিলেন লতাঙ্গি; ক’দিন পরেই একটি অনুষ্ঠানে গাইবেন।
যে ল্যাম্পপোস্টটায় তাঁর মাথাটি গিয়ে লেগেছিল, তার আড়াআড়ি উল্টো দিকে ঘাসে-ঢাকা ডিভাইডারে আজ দাঁড়িয়ে আছে আর-এক দীর্ঘদেহীর মূর্তি। মায়ের কাছে শুনেছিলাম, অনেক বছর আগে পূরবী মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্বামী প্রদ্যুম্ন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসেছিল গানের আসর। আমার বাবা-মা সেখানে ছিলেন। আজ যিনি মূর্তি, সেই দীর্ঘদেহীও ছিলেন শ্রোতা হিসেবে। গান গাওয়ার কথা ছিল গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর গুরুর। কিন্তু সেই গুরু সমেত আসরের সকলেই অন্য দীর্ঘদেহীকে ধরে বসলেন, ‘হেমন্ত, তুমিই একটা গান গেয়ে শুরু করো।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেজায় আপত্তি করেছিলেন। কেউ তা শোনেননি। অগত্যা তিনি গেয়েছিলেন। মা আমায় বলেছিলেন, ‘ওরে, ভাবতে পারবি না, কী-গান গেয়েছিল হেমন্ত।’ অয়ি ভুবনমনমোহিনী। যে দীর্ঘদেহী শিল্পীর আসর, তিনি আবেগে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলেন গায়ককে।
সাদার্ন অ্যাভিনিউ দিয়ে গেলে আজও হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় মায়ের কাছে শোনা সেই গল্প। ডিভাইডারের ওপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি। আড়াআড়ি উল্টো দিকে, রাস্তার এ-পারে, ল্যাম্পপোস্ট। লতাঙ্গি ভাঁজতে থাকা একটি মাথা ওই ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা মেরেছিল।
দক্ষিণী রাগ। বিচিত্র তার রূপ। শুদ্ধ রে, শুদ্ধ গা, তীব্র মা, পা, কোমল ধা, শুদ্ধ নি। ওই স্বরগুলির অচিন্ত্যপূর্ব কিছু বিন্যাসের সঙ্গে ল্যাম্পপোস্টটার ধাক্কা যে দিন লাগে, সে দিন আমার বয়স ছিল মোটামুটি দু’মাস কম পঁচিশ। যাঁর মাথা এই বিন্যাসগুলি বিদ্যুৎগতিতে সৃষ্টি করছিল, তাঁর বয়স ছিল কয়েক মাস কম তেষট্টি। আজ তেষট্টি বছর ছ’মাস বয়সে আমি তাঁর কথা ভাবছি, লিখছি।
ছবি: সুমন চৌধুরী
সে দিন ইউটিউবে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাজানো লতাঙ্গি শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, যে-লতাঙ্গির স্বরপরম্পরা ও বিন্যাস এক সন্ধ্যাবেলা ছুটন্ত গাড়িতে যেতে যেতে পূরবী মুখোপাধ্যায় শুনে নিয়েছিলেন, লতাঙ্গির যে বিশেষ মেজাজের শেষ সাক্ষী কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এর একটি ল্যাম্পপোস্ট, সে-লতাঙ্গির সম্ভাব্য অবয়বগুলি কেউ জানতে পারল না কোনও দিন। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এসেছিল চরম মুহূর্ত। আমাদের বাংলায় বসন্ত ওই সময়ে। তারই এক সন্ধেয় সেই দীর্ঘদেহী মানুষটি গুনগুন করছিলেন রাগটি। শিষ্যার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন নাম। বলেছিলেন— পরের অনুষ্ঠানে তিনি গাইবেন। বসন্তেই তো।
ইউটিউবে নিখিলের (নিখিলের পর বন্দ্যোপাধ্যায় পদবিটি লিখতে আমার সব সময়ে অস্বস্তি হয়: ঈশ্বরের পদবি আছে নাকি?) বাজানো লতাঙ্গি শুনতে শুনতে মনে হল, ওই যে তিনি তার সপ্তক থেকে শুরু করছেন, ওজনটা রাখছেন তার সপ্তকের সা, তার পরেই মধ্য সপ্তকের শুদ্ধ নি, কোমল ধা— আর সেখান থেকে পঞ্চমের ওপর, ওখানেই রয়েছে এক মধুর চাতুরি, যেটি ছাড়া সংগীত বৃথা। ওই স্বরগুলি বেয়ে বসন্ত রাগটি নেমে আসে আমাদের আওতায়। এই লোকপ্রিয় রাগের এ-হেন নেমে আসাতেই আমরা অভ্যস্ত। তীব্র মধ্যম ও শুদ্ধ গান্ধারকেও দু’বার পাশাপাশি রেখে নিখিল আরও কৌশল করছেন আমাদের সঙ্গে। এমন কায়দায় তিনি নামিয়ে আনছেন স্বরগুলোকে যে আমাদের মন অস্থির হয়ে উঠছে শুদ্ধ গান্ধার থেকে কোমল রেখাবে আসার জন্য। আর ঠিক এইখানেই লতাঙ্গির ব্যতিক্রম। এ রাগে রেখাব শুদ্ধ। তাই কোমলের বদলে শুদ্ধ রেখাবের প্রয়োগে চমকে উঠছি আমরা। এ কোন বসন্ত।
সে কেমন বসন্তকাল, যখন আমীর খানের মাথাটাকে কলকাতার আসরে তাঁর প্রিয় সহশিল্পী শ্যামল বসুর তবলায় বিলম্বিত ঝুমরার শেষ তে-রে-কে-টে’র পর অমোঘ সম্-এ নয়, কলকাতার এক ল্যাম্পপোস্টে গিয়ে আছড়ে পড়তে হয়। সে কেমন বসন্ত, যখন কলকাতা পাওয়ার আগেই চিরকালের মতো হারিয়ে ফ্যালে তার লতাঙ্গির প্রথম স্বাদ। কত আসরে দেখেছি আমীর খান গাইছেন, আর সামনের সারিতে বসে শুনছেন নিখিল। পেছন থেকে আমরা শুধু আমীর খানের মেঘ বা যোগ বা আভোগী কানাড়া, শুধু শ্যামল বসুর ধীর-স্থির তবলা শুনতাম না, নিখিলের শোনাটাও শুনতে চেষ্টা করতাম কেউ কেউ। দেখতাম। সে কেমন যুগ ছিল, যখন আসরের শ্রোতারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন: আজ নিখিল এসেছেন। আজ যা গান হবে! তেমনি, মনে আছে, কলামন্দিরে নিখিল বাজাচ্ছেন। ইমন। সামনের সারিতে একেবারে কোনার আসনে বসে আছেন দীর্ঘদেহী এক পুরুষ। রসিক এক মাঝবয়সি শ্রোতা সামনে গিয়ে দেখেও এলেন। ফিরে এসে ফিসফিস করে বললেন: আজ নিখিল যা বাজাবেন, তা আসলে ঠিক আমাদের জন্য নয়, আর-এক ভগবানের জন্য। আজ ভগবানে-ভগবানে লেনদেন।
তাই কি? আমাদের জন্য নয়? কলকাতার এক অনুষ্ঠানে আমীর খান গাইছেন। পর্দা উঠতেই অডিটোরিয়ামের আলো জ্বালিয়ে দিতে বললেন। আলো জ্বলে উঠতে দেখা গেল শ্রোতাদের সংখ্যা খুবই কম। তিনি বললেন— ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে সকলে সামনে চলে আসুন, অনেক জায়গা আছে। কোনও রকমে তিনটি সারি ভরল কি না সন্দেহ। টানা আড়াই ঘণ্টা গাইলেন শিল্পী। সে আসরে কিন্তু নিখিল ছিলেন না। শুধু আমাদের জন্য।
আমার এ এক রোগ। আজকাল নিখিলকে বাদ দিয়ে আমীর খানকে ভাবতে পারি না। আমীর খানকে বাদ দিয়ে ভাবতে পারি না নিখিলকে। ইউটিউবে নিখিলের লতাঙ্গি শুনতে শুনতে ভাবছিলাম— সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এর ঘটনাটা না ঘটলে আমীর খানের কাছ থেকে যে লতাঙ্গি আমরা পেতাম, সে বোধহয় শুরু হত তার সপ্তকে নয়, মধ্য থেকে মন্দ্রে। মন্দ্র সপ্তক, যেটি আমীর খান দিয়ে গিয়েছেন হিন্দুস্তানি কণ্ঠসংগীতের গায়কীকে। অত যত্ন করে, ধৈর্য ধরে আর কোনও কণ্ঠশিল্পী খেয়ালের স্বরবিস্তারে মন্দ্র সপ্তককে অতটা প্রাধান্য দেননি বোধহয় তাঁর আগে। পূর্বাঙ্গপ্রধান (অর্থাৎ, মন্দ্র ও মধ্য সপ্তক প্রধান) রাগে তো বটেই, এমনকী উত্তরাঙ্গপ্রধান (তারসপ্তক-নির্ভর) রাগেও। স্বরবিস্তারে তো বটেই, সরগমেও।
মধ্য সপ্তকের সা থেকে মন্দ্র সপ্তকের, ধরা যাক, নিখিলের প্রাধান্য দেওয়া স্বরগুলিই যদি তিনি গাইতেন, সম্ভবত সপ্তকের কারণেই বসন্তবিলাসী হয়ে উঠতে চাইত না আমাদের মন। আর-এক দীর্ঘদেহী যেমন বসন্তের বিরহকে ধরতে গিয়ে সব সময়ে মরসুমি রাগের শরণ না নিয়ে বরং অ-মরসুমের রঙে-রসে নিয়ে গিয়েছেন আমাদের, ল্যাম্পপোস্টে মাথা খোঁড়া এই দীর্ঘদেহীটিও হয়তো তেমনি অন্য কোনও রঙে ছোপাতেন লতাঙ্গির ধরতাইটাকে।
সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এর ল্যাম্পপোস্টটা জানতেই পারল না কী ঘটে গেল, কত কী ঘটল না। সে কেমন বসন্ত ছিল। কেমন ছিল সেই সন্ধেতে ল্যাম্পপোস্টটার মাথায় লাগানো আলোর রঙ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.