রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
রুম সার্ভিস
রুম সার্ভিস কেবিনে প্রথমেই পাঁচুবাবুর সঙ্গে আলাপ হল। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ভুলে সবাই তাঁকে পাঁচুবাবু বলেই ডাকে। পরে দেখেছি, বাড়ি থেকে ফোন এলেও পাঁচুবাবুকে খোঁজে— জানে অন্য নামে তাঁকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রথম দিন কাজ বোঝানোর ফাঁকে উনি দু’টো কথা বললেন, যার চেয়ে সত্যি আর এ জীবনে শুনিনি। হোটেল হল মহাশ্মশানের চিতার মতন— বারো মাস চব্বিশ ঘণ্টা চালু। আর, হোটেলের ছুটি তাই ‘বি. জি. অ্যাক্ট’-এ চলে— বার্নিং ঘাট অ্যাক্ট— ছুটিছাটা বলে আসলে কিচ্ছু নেই।
পাঁচুবাবুকে বেশ পছন্দ হলেও, ওয়েটাররা দেখতাম তাঁর নেওয়া অর্ডার সন্দেহের চোখে দেখে। পরে শুনি, ওঁর ঘাড় মাঝেমাঝে লক হয়ে যায়, তাই ফোনে অর্ডার নিতে নিতে উনি মাঝে মাঝেই ঘাড়ে ঝটকা মারেন— রিসিভার দূরে চলে যায়। এক বার এক অতিথি (হোটেলের সব বোর্ডারকে ‘গেস্ট’ বা অতিথি বলা হয়) চা-বিস্কুটের অর্ডার দিয়েছিলেন। ঘরে শুধু বিস্কুট পৌঁছয়— কারণ তিনি যখন ‘চা’ শব্দটি বলেন, তখন পাঁচুবাবু ঘাড়ের লক খুলছিলেন। আর এক বার এক অতিথি ওয়েটারকে তাড়া করে রুম সার্ভিস অবধি চলে এসেছিলেন— ‘হুইস্কি, সোডা, আইস’ অর্ডারের পর ঘরে যখন শুধু সোডা আর বরফ পৌঁছল।
রোজ বিকেল পাঁচটা নাগাদ একটা বেড়াল হোটেলের রসুইঘরে বেড়াতে আসত। আমি প্রথম দিন দেখি, রুম সার্ভিস কেবিনের সামনে একটা চক্কর মেরে ইংলিশ কিচেনের চৌহদ্দির মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল। চমকে উঠে তাড়াতে গেলাম, কোনও পাত্তাই দিল না। বুঝলাম, এখানে বেড়ালও ‘ট্রেনি’দের মানে না। খানিক ক্ষণ বাদে ম্যাথু’দা এসে রেড ওয়াইনের বোতল থেকে কিছুটা প্লেটে ঢেলে বেড়ালটার দিকে এগিয়ে দিল। সে চকচক করে পুরোটা শেষ করে, আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল। পাশ থেকে ডেভিড ম্যাপেল বলল, ‘শালা পুরা অ্যালকোহলিক বন গয়া।’ শুনলাম বেড়ালটাকে প্রথমে এক চামচ করে রেড ওয়াইন খাওয়ানো হত— এখন এর ক্যাপাসিটি বেড়ে গেছে। বেশ ক’বছর পর, এক দিন রসুইখানায় বেড়াতে গিয়েছি। ম্যাথুদা’কে জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম বেড়ালটা মারা গেছে। পাশ থেকে ভাস্করদা বলে উঠল, ‘সিরোসিস অব লিভার হয়েছিল। পেটব্যথায় খুব কষ্ট পেয়েছে মরার আগে।’
হোটেলে হরেক রকম যন্ত্রপাতি বয়লার থেকে শুরু করে এয়ার কন্ডিশনিং প্লান্ট অবধি সব কিছুই থাকে। এত বিভিন্ন রকমের যন্ত্রপাতি জাহাজেও থাকে, তাই জাহাজের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়াররা ডাঙায় পাকাপাকি ভাবে নোঙর ফেললে হোটেল জগতে প্রবেশ করতেন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। আমাদের হোটেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার সরকার সাহেব ছিলেন এই রকম এক প্রাক্তন জাহাজি। কোনও গূঢ় কারণে তিনি সমস্ত যন্ত্রপাতির লিঙ্গ নির্ধারণ করতেন। অনেক দিন ধরে আইস কিউব মেশিন বিকল হয়ে আছে। অজয় ধাওয়ান এক দিন হোটেল পরিদর্শনে বেরিয়েছেন, রুম সার্ভিস কেবিনে আসতে ‘জয় মা’ বলে ওঁর কানে কথাটা তুললাম। তিনি তক্ষুনি সরকার সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। এবং রাগে ফেটে পড়লেন, যখন সরকার সাহেব কৈফিয়ত দিলেন, ‘she is not producing as insulation is unable to excite her.’
ছবি: সুমন চৌধুরী
এক বেয়ারা ছিল, তবারক আলি। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় হোটেলের হাউজকিপিং বিভাগে রাত্রির শিফ্ট ছিল না। রাত দশটা থেকে সকাল সাতটা অবধি ছিল হাউজকিপিং-এর বেয়ারাদের অবাধ রাজত্ব। এ দিকে ভোরের দিকেই বেশির ভাগ অতিথি তাঁদের ঘরগুলি ছেড়ে দিতেন, সকালের প্লেন কিংবা ট্রেন ধরার জন্য। রুম সার্ভিসের ওয়েটারদের সঙ্গে হাউজকিপিং-এর বেয়ারাদের অলিখিত চুক্তি ছিল— রুম সার্ভিসের ওয়েটাররা সকালের চা-বিস্কুট সরবরাহ করবে, আর বিনিময়ে ভোরবেলা চেক-আউট হওয়া কোনও ঘরে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারবে। এক অতিথি ভোরের ট্রেন ধরতে হোটেল থেকে সবে বেরিয়েছেন, আর তাঁর মনে পড়েছে তাড়াহুড়োয় ঘরে এক জরুরি প্যাকেট ফেলে এসেছেন। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে গিয়ে, দু’মিনিটের মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে ফ্যাকাশে মুখে জানালেন, তাঁর ঘরে এক ‘নাংগা ভূত’ রয়েছে। ঘরটায় পৌঁছে জানা গেল, তবারক আলি ওই কামরায় গোসল করছিল— ঘরে আওয়াজ হওয়াতে সে বাইরে বেরিয়ে আওয়াজের উৎস দেখতে গিয়েছিল— ভুলে গিয়েছিল সে তখন জন্মদিনের পোশাকে আছে।
তবারকের দোসর ছিল আসগর হোসেন। লাঞ্চ বা ডিনার নিয়ে যেতে তার খুব আগ্রহ। কারণ অতিথিরা মোটা বকশিস দিতেন। আর ততটাই অনীহা বেড-টি নিয়ে যেতে। এক দিন হোটেলে হুলুস্থুলু। আসগর ঘুমচোখে চায়ের সঙ্গে চা-চামচের বদলে ভাতের চামচ নিয়ে চলে গিয়েছে। গেস্ট ভদ্রলোক রেগেমেগে চামচটা তুলে দেখাতে, পরিস্থিতি সামাল দিতে আসগর গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছে, ‘এটা বড় হোটেল। এখানে সবই বড় বড়।’
ড্যালাস যখনই আমার শিফ্টে অর্ডার- টেকারের চেয়ারে বসত, জানতাম কপালে দুঃখ নাচছে। এক বার এক জন গেস্ট তাকে ‘স্ক্রু ড্রাইভার কক্টেল’ অর্ডার করে একটা বিশাল স্ক্রু ড্রাইভার পেয়েছিলেন। আর এক দিন এক ভি.আই.পি অতিথি তাঁর ঘরে পার্টি দিয়েছেন। রুম সার্ভিসে ফোন করে তাঁর স্ত্রী বিরাট লম্বা অর্ডার দিয়েছেন। ওয়েটার খাবার সাজিয়ে নিয়ে ঘরে পৌঁছে দিতে গেছে। তার পর হইচই। অতিথির ঘরে শুধু ভাত, রুটি, নান, স্যালাড, রায়তা, আচার গিয়েছে— কোনও মেন ডিশ পৌঁছয়নি। ড্যালাসকে জিজ্ঞেস করায় সে নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিল, ‘এত অর্ডার করছে, লেখার জায়গা ছিল না।’
আর এক দিন আমি ডিউটিতে। সঙ্গে রুম সার্ভিস ক্যাপ্টেন সন্দীপ। ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ম্যানেজারের ঘর থেকে জরুরি তলব এল। দুরু দুরু বুকে ওঁর অফিসে গিয়ে দেখি তিনি গম্ভীর মুখে সিগারেট খাচ্ছেন। জানতে পারলাম, অর্ডার-টেকার চান্দ্রেয়ীর বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার তাঁর মেয়ের পদত্যাগপত্র দিয়ে গেছেন— আর সন্দীপ ও হোটেলের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন, তাঁর সামরিক জীবনের সম্মানকে আঘাত করার জন্য। কেন? কী ঘটেছে? আগের দিন চান্দ্রেয়ীর বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায়, ওঁর বাবা ফোন করে জানতে চান চান্দ্রেয়ী কখন হোটেল থেকে বেরিয়েছে। ফোনে উনি স্বভাবসিদ্ধ ফৌজি কায়দায় কথোপকথন শুরু করেন— ‘ব্রিগেডিয়ার রায়চৌধুরী বলছি’ বলে। তক্ষুনি সন্দীপ উত্তর দেয়, ‘ক্যাপ্টেন সন্দীপ বলছি।’ রসিকতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিগেডিয়ারের হেন আচরণ। সন্দীপকে ডেকে পাঠিয়ে ম্যানেজার কেটে কেটে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নামটা শুধু বললেই পারতে, ক্যাপ্টেন বলার কী দরকার ছিল?’ সন্দীপ বীরদর্পে বলল, ‘কেন স্যর, আমি তো রুম সার্ভিস ক্যাপ্টেন, উনি যদি ব্রিগেডিয়ার হিসাবে গর্বিত হন, আমিও তা হলে ক্যাপ্টেন হিসেবে গর্বিত।’
হোটেলের টেলিফোন বিভাগের সঙ্গে রুম সার্ভিসের গভীর যোগোযোগ। অতিথিদের এক এক জনের এক এক সময় ঘুম ভাঙানোর অনুরোধ থাকত। দে-বাবু ছিলেন রাতের শিফ্টের টেলিফোন অপারেটর। টানা পঁচিশ বছর রাতের শিফ্টে কাজ করে ওঁর রুটিন বদলে গিয়েছিল। বুধবার ছিল তাঁর ছুটি, সেই দিনও তিনি সারা রাত বিছানায় ঠায় বসে থাকতেন। বাড়ির লোকেরা ঘুমোত। দে-বাবু রাত বারোটার পর ফোন ধরলে কখনও ‘গুড মর্নিং’ বলতেন না, ‘গুড নাইট’ বলতেন। টানা পঁচিশ বছর এটা কেউ বদলাতে পারেনি।
অনেকের কথা লেখা হল না— টেলিফোনের মিস চ্যাটার্জির কথা, যিনি ‘মে আই হেল্প ইউ’-কে ‘মেল্পু’ বলতেন, শার্লি মেমসাহেবের কথা— যিনি মাসের শুরুতে মেরিলিন মনরো স্টাইলে ‘কিং সাইজ’ সিগারেট খেতেন, আর মাসের শেষে লুকিয়ে বিড়ি টানতেন। দত্তদার কথা, যে অবলীলাক্রমে বিদেশিদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলত এবং কী ভাবে জানি না, সব্বাই সারমর্ম বুঝতে পারত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.