নাড়ুমামার গুপ্পি মারা কথা শুনে ঋকুর চোখ ছানাবড়া। বলে কী নাড়ুমামা! নাকি জ্বলজ্যান্ত স্পাইডারম্যান এই পুরীতেই আছে এবং তা ঋকুকে দেখাবে? সাতসমুদ্র ডিঙিয়ে স্পাইডারম্যানের খেয়েদেয়ে কাজ নেই, সে কিনা এই পুরীতে হাজির হবে?
হোটেলের বারান্দায় চায়ে চুমুক মেরে নাড়ুমামা বলল, হ্যাঁ রে সত্যি। বিশ্বাস কর এই পুরী চত্বরেই আছে। যাকে বলে ইন্ডিয়ান স্পাইডারম্যান। তোদের স্পাইডারম্যানের সাহেব অ্যাক্টর টবি মেগার বা অ্যানড্রিউ গারফিল্ডও নয়। বুঝেছিস?
ছটপটে ঋকু বলে, সত্যি বলছ? দেখাতে পারবে? গুল মারছ না তো?
প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। নাড়ুমামার মুখে রহস্য হাসি।
তোর নাড়ুমামা কখনও আজেবাজে গুল মারে না। আজ বিকেলেই দেখাব।
আজ বিকেলেই?
হ্যাঁ, মন্দির চত্বরে।
ঋকুর মগজে দুষ্টু বুদ্ধির বাসা। মন্দির চত্বর শুনেই হি হি হাসে।
ও, তার মানে তুমি স্পাইডারম্যাঙ্কের কথা বলছ?
নাড়ুমামা ভাগ্নেচন্দ্রের কথা শুনে বলে স্পাইডারম্যাঙ্ক! মানে? ঋকু বিজ্ঞের মতো হাসে। ম্যাঙ্ক হচ্ছে গিয়ে মাঙ্কির শর্ট ফর্ম।
আজ সকালেই ঋকু মাম আর পাপার সঙ্গে মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিল। নাড়ুমামা শরীর খারাপের জন্য যেতে পারেনি। সেই বিরাট, বিশাল উঁচু মন্দিরের যত্রতত্র অনেক বাঁদর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ওর চোখের সামনে দিয়ে একটা ইয়া লম্বা লেজওয়ালা বাঁদর এক জনের হাত থেকে ছোঁ মেরে কলার ছড়া নিয়ে পালিয়েছিল। ওটা নিয়েই চোঁ-চোঁ করে মন্দিরের গা বেয়ে উঠে গিয়েছিল। ওর পিছু পিছু কয়েকটা বাচ্চা বাঁদর। ঋকুরা তখন লাইনে দাঁড়িয়ে, পুজো দেবে বলে। তবে কি নাড়ুমামা ওই স্পাইডারম্যাঙ্কের কথা বলছে? না হলে আর কার কথা বলবে? পুরীতে অনেক উঁচু হোটেল হয়েছে ঠিক কথা। কিন্তু স্পাইডারম্যান কি হোটেলের গা বেয়ে টপ ফ্লোরে কেউ বিপদেটিপদে পড়লে বাঁচাতে আসে? নাড়ুমামা তো আবার বলছে ইন্ডিয়ান স্পাইডারম্যান! ঋকুর সব কেমন গুলিয়ে যায়। |
সমুদ্রপাড়ে স্নান করতে গিয়ে উট, ঘোড়া দেখেছে। উৎপটাং নীল ঢেউগুলো মুখে সাবান ফেনা নিয়ে পাড়ে আছড়ে পড়তে দেখেছে। ভিজে বিচে আটকে থাকা সাদা সাদা ঝিনুক দেখেছে। ফিশারম্যানকে নৌকো নিয়ে মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরতে দেখেছে। টুপি মাথায় নুলিয়া দেখেছে। এমনকী যখন মন্দির থেকে ফিরে এসে আজ নাড়ুমামার সঙ্গে জলে নেমেছিল। তখন মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে কালোসাদা ডানা মেলা প্রজাপতি বা মথ উড়তে দেখেছে। দারুণ দেখাচ্ছিল। নাড়ুমামা তখন ঢেউয়ে গা এলিয়ে সাঁতার দিচ্ছিলেন। ঋকু চিৎকার করে বলেছিল, ওই দেখো নাড়ুমামা প্রজাপতি। হুম, মথও হতে পারে, ভাগ্নেচন্দ্র। কথাটা বলে জলে ভুস করে ডুব দিয়েছিল নাড়ুমামা। স্বর্গদ্বারে পুরীর খাজা খেতে গিয়ে সাদা বড়সড় কথা বলা কাকাতুয়া দেখেছে। যদিও খাঁচায় বন্দি। ওর মন খারাপ হয়েছিল। তবুও কাকাতুয়া তো! সাদা ফরফরে পালক ঢাকা। মাথায় ঝুঁটি, কী দারুণ।
এত কিছু দেখেছে। এমনকী আগামীকাল সবাই মিলে চিলকা হ্রদ দেখতে যাবে। সেখানে নাকি অনেক ডলফিন, লাল কাঁকড়া আছে। এটাও তো কম সারপ্রাইজ নয়। কিন্তু স্পাইডারম্যান! উঁহু, কিছুতেই মানতে পারছে না ঋকু। ওর মনে চিন্তা শুরু। কখন বিকেল হবে?
যা-ই হোক, ঠিক পড়ন্ত রোদ-বিকেলে নাড়ুমামার হাত ধরে ঋকু মন্দিরে হাজির হল। মনে মনে কী টেনশন। শেষে পুরোটাই ম্যাজিক বলে নাড়ুমামা হাপিশ করে দেবে না তো? কিচ্ছু বিশ্বাস নেই। কত বার গুল মেরে ধরা পড়ে নাড়ুমামা ম্যাজিক বলে হাপিশ করেছে।
তখন মন্দিরের চাতালে অনেক মানুষ। কেউ কেউ বসে কেউ-বা দাঁড়িয়ে। মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকিয়ে।
ঋকু প্রশ্ন করে, নাড়ুমামা, ওরা চূড়ার দিকে চেয়ে রয়েছে কেন?
মন্দিরের চূড়ায় তখন রঙিন সাটিনের কাপড় বাতাসে উড়ছে।
একটু অপেক্ষা করো ভাগ্নেচন্দ্র। এক্ষুনি দেখতে পাবে জ্বলজ্যান্ত এক জন স্পাইডারম্যান তরতর করে ওই মাথায় উঠে যাবে। আর ওই রঙিন কাপড় তথা ধ্বজা পেড়ে নিয়ে আসবে।
বলতে বলতে সবাই ‘জয় প্রভু জগন্নাথ দেবের জয়’ বলে উঠল। খোল-কত্তাল বাজিয়ে ঠাকুরের গান গাইতে শুরু করল। আর দেখা গেল এক সুন্দর, যাকে বলে সিক্স প্যাক, স্বাস্থ্যবান যুবক, হাঁটু পর্যন্ত ধুতি পরে তরতর করে মন্দিরের গা বেয়ে উঠে যাচ্ছে। তার হাতে কোনও ম্যাজিক নেট নেই। মুখে মুখোশ নেই। কোনও পাইপ বেয়েও নয়, শুধু শক্তির ওপর ভর করে উপরের দিকে উঠে চলেছে। সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে। বুকটা ধুকপুক করছে। যদি পড়ে যায়!
ঋকু ভয়ে জড়োসড়ো। নাড়ুমামার হাতটা শক্ত করে ধরে। প্রশ্ন করে নাড়ুমামাকে, যদি স্লিপ করে পড়ে যায়? প্রায় দুশো ফুট উঁচু মন্দির। পড়ে গেলে আস্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। নাড়ুমামা বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে তখন।
বলেন বললেই হবে, আমাদের ইন্ডিয়ান স্পাইডারম্যান বলে কথা!
লোকটি চূড়ায় লাগানো ধ্বজাটা নামাল। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া নতুন ধ্বজা লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরে ঠিক একই উপায়ে নেমে এল। ভক্তবৃন্দ ‘জয় প্রভু জগন্নাথ’ বলতে বলতে এগিয়ে গেল। শুধু একটু ছোঁবে বলে। আর ওই ধ্বজার অজস্র টুকরো ঠাকুরের আশীর্বাদ হিসাবে গ্রহণ করবে বলে। বাড়িতে রাখলে নাকি মঙ্গল হয়।
ঋকু দেখছে ইন্ডিয়ান স্পাইডারম্যানের পেশি বেয়ে ঘাম ঝরছে। শরীরের প্রতিটি খাঁজে খাঁজে আলো পড়ে চিকচিক করছে। ঋকুর চোখের পলক পড়ে না। নাড়ুমামা ঠ্যালা মারে, চল ফিরতে হবে না?
ঋকু বলে, চলো। নাড়ুমামার উক্তি ভাসে, ভাগ্নেচন্দ্র, আর যা-ই হোক নাড়ুমামা গুল মারে না কখনও। ঠিক কি না? ঋকু হাসে। বলে ঠিক ঠিক। |