প্রবন্ধ...
স্বর্গে কয়েক দিন
বেশ ছিলাম লেপের ওমের মধ্যে। হিম ঠান্ডায় আলসেমিটা কিছুতেই যাচ্ছিল না চোখের পাতা থেকে। কিন্তু এত সুখ সইলে তো! ফরমান জারি হয়ে গিয়েছে, অষ্টমীর দিন মা দুগ্গার মুখ না দেখে বেলা ন’টা অবধি ঘুমোনো কিছুতেই চলবে না এবং ওই প্রবল ঠান্ডাতেও রীতিমত স্নান সেরে ঠাকুর-দর্শন করতে যেতে হবে। বড়রা চিরকালই অবুঝ, যখনতখন আবদেরেপনা শুরু করে দেয় এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই চানঘরে। একেই এ বারের পুজোয় সাত-সকালে ঢাকের বাদ্যি নেই, দু-হাত অন্তর থিম পুজোর হিড়িক চোখে পড়ছে না, ধূপের প্যাকেট, ফুলের সাজি আর মিষ্টির বাক্স হাতে সদ্যস্নাতা, লাল-সাদা শাড়ি পরিহিতা মাতৃমূর্তির বদলে সামনে দেখছি মোজা-সোয়েটার-শালমুড়ি দেওয়া এক বিরসবদনাকে (অবশ্যই পুজোর সময়ে কলকাতা ছেড়ে আসার কারণে), তার ওপরে হিম-সকালে স্নান। এই প্রথম অষ্টমীর সকালেই মনটা এমন তেতো হয়ে গেল।
ভেবেছিলাম হয়তো বরফমাখা পাহাড়চুড়ো এ দুঃখ খানিকটা কমাতে পারবে। কিন্তু সে-ও সুযোগ পেয়ে দুষ্টুমি শুরু করেছে। পরশু এসেছি, এক বারও পুরো রেঞ্জটা ধরা দিল না। কখনও দেখছি ডান দিক, কখনও বাঁ দিক, কখনও শুধুই ওপরের ছুঁচোলো দিকটা। মেঘগুলো মনে হয় আকাশে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে ঠিক যেন পাহাড়ের কোলেই সেঁধিয়ে যেতে চাইছে।
ভারী মনে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছিলাম ম্যালের দিকে। এখানকার পুজোটা অবশ্য বেশ জাঁকজমক করেই হয়। তবে বাড়িতে ফেলে আসা তুঁতেরঙা ঢাকাই আর পাড়ার পুজোয় বন্ধুদের সঙ্গে অঞ্জলি দেওয়ার কথা মনে পড়ে অবাধ্য চোখের কোলটা বার বার ভিজে উঠছে। বাবার নাগাড়ে সান্ত্বনা দেওয়া কথাগুলোও কান থেকে পিছলে যাচ্ছে। হঠাৎই নিজেকে চমকে দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল গলা দিয়ে। প্যান্ডালে শুরু হয়েছে পুজো, আর ঠিক তার পিছনেই আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা, রোদ পড়ে ঝলমল করছে মায়ের মাথার মুকুটের মতো।
তখন স্কুলে পড়ি। সে সময় পুজোর ছুটিটা আসত মহালয়ার দিন থেকে, আর গড়িয়ে গড়িয়ে থামত ভাইফোঁটার পরের দিন। আর সেই এক মাস জুড়ে প্রতিটি দিন, প্রত্যেক মুহূর্ত টিপে টিপে খরচ করতাম আমি। প্রাণপণে শুষে নিতাম সেই দিনগুলোর জীবনীশক্তি। আর এই পুঁজি নিয়েই যুঝতাম বাকি এগারো মাসের কম্পিটিশন, পরীক্ষার ভয় আর মনখারাপের সঙ্গে।
এক বারই শুধু কলকাতার বদলে বাবা পুজো কাটানোর জন্য বেছে নিয়েছিল দার্জিলিং। সে বারের অভিজ্ঞতার কথাই বলছিলাম। মনে আছে, নবমীর বিকেলে কলকাতার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম জুড়ে যখন ঢল নেমেছে মানুষের, আমি তখন নিভে আসা বিকেলের আলোয় ঘোড়ার পিঠে কুয়াশামাখা অবজারভেটরি হিল-এর রাস্তায় চক্কর কাটছি। একা। দশমীর ভোরে সারা বাংলায় যখন বাঙালির সেরা উৎসবের আলো নিভু নিভু, আমরা তখন টাইগার হিলে। টুকটুকে লাল সূর্যের প্রথম আলোর মায়াবি খেলা দেখছি আকাশ জুড়ে।
তবে সেটা ছিল ব্যতিক্রম। অন্য বছর পুজোর সময় কলকাতা ছাড়ার কথা ভাবতামই না। বেড়ানোর জন্য লক্ষ্মীপুজোর পরের সময়টাকেই বেছে নেওয়া হত। আর ঠিক এই জন্য দশমীর পরেও ‘এ বছরের মতো পুজো শেষ’-এর দুঃখটা তেমন ছুঁতে পারত না আমায়। কারণ বন্ধুরা যখন বেজার মুখে ফেলে রাখা বইয়ের পাতা উল্টোতে বসত, আমি তখন দরকষাকষি জুড়েছি ক’টা নতুন জামা সুটকেসে ঢোকাতে পারব, সেই নিয়ে।
বছরে এক বার অন্তত উত্তরবঙ্গ যাওয়া ছিল আমাদের বাঁধা। বাবার চাকরির কারণে আমার ছেলেবেলাটা কেটেছিল সেখানেই। তাই মাঝেমধ্যেই ছুঁতে চাইতাম ফেলে আসা স্মৃতিগুলোকে। এই জন্যই বোধহয় দার্জিলিং, সিকিম, কালিম্পং, কার্শিয়াং, ডুয়ার্স-সহ অনেক জায়গাই আমার দেখা হয়ে গিয়েছে, একাধিক বার। আর এই স্মৃতির টান এতটাই জোরালো যে নিছক পর্যটকের মতো সে আমাকে শুধু ফাইভ পয়েন্টস্ বা বটানিক্যাল গার্ডেন-এর আশেপাশেই টেনে নিয়ে যায়নি, পাহাড়ি গ্রামগুলোর খেটে-খাওয়া মানুষদের সরল জীবনের কিছু ছবিও হাজির করেছিল চোখের সামনে। এই কারণেই হয়তো কেভেন্টার্স-এর ছাদ, গ্লেনারিজ আমার মনকে যতটা ছুঁয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল রিশপ-এ আন্টির হোটেলে কাঠের রান্নাঘরের এক পাশে বসে লাল ডিমের তরকারি, রুটি আর লেবুর আচার খাওয়া। কিংবা নাথু লা’য় ভারত-চিন বর্ডারে দাঁড়িয়ে এক সামরিক উর্দির মাউথঅর্গ্যান শোনা। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শেয়ারের জিপে উঠলেই তাই এখন পাহাড়ের গন্ধ পাই। রাস্তার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা নাম-না-জানা বুনো ফুল, খাদ বেয়ে উঠে আসা কুয়াশা আর পাহাড়ের ঝুরো মাটির গন্ধ মেশানো থাকে সেখানে। জিভে আচমকা কাঠের আগুনে সেঁকা অল্প পোড়া গরম রুটি আর ভাপা মোমোর স্বাদ।
তাই আমার পড়ুয়া-বয়সের পুজোর ছুটি মানে ব্যাগ হাতে এন জে পি স্টেশনে পা রাখা, আর বড়রা যখন গাড়ি খোঁজায় ব্যস্ত, তখন আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার কোনও অংশ এক বারের জন্য চোখে পড়ল কি না। আর তার পর? কখনও সুনতালেখোলার ঝুলন্ত ব্রিজে দোল খাওয়া, কখনও মিরিকে বোটে ভাসা, কখনও নাথু লা যাওয়ার জন্য ভাড়া করা জব্বর ওভারকোট গায়ে গলানো, আবার কখনও বিকেলের পড়ন্ত রোদে চাপড়ামারিতে বাইসন দেখতে যাওয়া।
পাঁচ-সাত দিন ধুলো-ধোঁয়াহীন দুনিয়ায় কাটানোর পর যখন নেমে আসতাম, তখন শহর জুড়ে আবার উৎসবের তোড়জোড়। দেওয়ালির সাজে সাজানো শহরটায় তখন খুঁজতাম মিশকালো পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া আলোর বন্যাকে, আতসবাজির রোশনাইয়ে খুঁজতাম সানরাইজ-এর রঙের খেলাকে। পেতাম না। তাজা অক্সিজেনের খোঁজে বুক ভরে শ্বাস নিতে চাইতাম, সে নিঃশ্বাস ধুলোয় ভরে মাঝপথেই আটকে যেত। ছ’টা বাজলেই শহর জুড়ে আলোর ঝলকানি মন থেকে মুছে দিতে চাইত খাদের গা বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসা সন্ধের স্মৃতিকে।
তাই, সমতলে পাহাড়ি আমেজ খোঁজার চেষ্টা এখন ছেড়ে দিয়েছি। পাহাড় থাক তার জায়গায়, চাপা থাক কুয়াশা আর আলো-আঁধারির আড়ালে। খামখা তাকে নীচে টেনে এনে দূষিত করার দরকার কী!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.