ঐতিহ্য ধুয়ে জল খাওয়ার দিন শেষ! লাখ লাখ সদস্য-সমর্থক আর চালিকাশক্তি নয় সাফল্যের!
শুক্রবার ময়দানের ‘নতুন এল ক্লাসিকো’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ক্লাব ফুটবলে সাফল্যের চাবিকাঠি এখন লুকিয়ে আছে, সফল টিম ম্যানেজমেন্ট আর নিখুঁত ফুটবলার নির্বাচনের উপর।
যুবভারতীতে শুক্রবার র্যান্টি বনাম ওডাফা কিংবা টোলগে বনাম কেন ভিনসেন্ট লড়াই বা বিশ্বকাপার কার্লোস হার্নান্ডেজকে দেখতে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মোহনবাগান সমর্থক। ১-২ পিছিয়ে পড়ার পরে কর্তাদের উদ্দেশে জুতো, জলের বোতল ছুড়লেও তাঁরা কিন্তু আদতে দেখতে এসেছিলেন প্রিয় দলের একটা জয়। অন্য দিকে মাঠে প্রয়াগ সমর্থক ছিলেন কুড়িয়ে বাড়িয়ে বড়জোর জনা তিরিশ। কিন্তু তাতে তো কোনও প্রভাবই পড়ল না খেলায়। ড্যাং ড্যাং করে গোয়ার মতো কলকাতার যুদ্ধেও ওডাফাকে হারিয়ে ম্যাচ জিতে গেলেন র্যান্টি মার্টিন্স।
দু’বছর কোনও ট্রফি নেই বাগানে। তিরিশ কোটি টাকা জলে গিয়েছে। সে জন্য ট্রফি পেতে ওডাফার সঙ্গে ক্লাব কর্তারা জুড়ে দিয়েছেন টোলগে ওজেবেকে। লাল-হলুদ থেকে তাঁকে নিজেদের জার্সি পরাতে প্রায় আড়াই মাস অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ক্লাব কর্তাদের। কিন্তু বাগানে এসে অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত ব্যর্থ। দু’কোটির স্ট্রাইকারএ দিন মোট দশটা বল ধরেছেন। একবার গোলে শট মেরেছেন। বাকি সময় বলের জন্য হা-পিত্যেশ করে মরেছেন। ওডাফাকে সতীর্থরা বল তুলে গিয়েছেন নাগাড়ে, টোলগেকে নয়। ওডাফা নিজে সব মিলিয়ে টোলগেকে বল দিয়েছেন দু’টি! কেন? কারণ ওডাফা এবং টোলগের মধ্যে এখন আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। |
আর কতক্ষণ? ছবি: উৎপল সরকার |
স্ট্রাইকাররা স্বার্থপর হয়। দুই তারকা যদি স্ট্রাইকার হয়, তাদের মধ্যে ইগোর লড়াই হবেই। সেটাই হচ্ছে। পুরো টিমের উপর এর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এই সম্পর্কটা মেরামত করার দায় ছিল কার? দু’জনের। কোচের আর ক্লাবে যাঁরা ফুটবল চালান তাঁদের। কিন্তু দু’জনের কেউই সেটা করেননি।
নভিস, দায়িত্বজ্ঞানহীন সন্তোষ কাশ্যপের মতো একজন কোচের হাতে পড়ে পুরো দলটারই একটা ছন্নছাড়া চেহারা এখন। কেমন কোচ এই কাশ্যপ? একটা উদাহরণ দেওয়া যাকটিমটাকে ৯৮ দিন অনুশীলন করিয়েছেন সন্তোষ। এর মধ্যে মাত্র তিন দিন সেট পিস অনুশীলন করিয়েছেন। অথচ আধুনিক ফুটবলে কর্নার, ফ্রি কিক এখন গোল পাওয়ার এক নম্বর চাবিকাঠি।
সন্তোষ কাশ্যপকে বাতিল করা হবে এ দিনের পর মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন মোহনবাগান কর্তারা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে সেটা হয়েও যাবে। কিন্তু তাতে কী? টিমটার যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। এ বারও। গতবার ভাষ্যকার কোচ স্টিভ ডার্বিকে জামাই আদর করে এনে ডুবেছিলেন কর্তারা। এ বারও একই অবস্থা। আবার কেউ একজন হয়তো নতুন কোচ হবেন। এসে বলবেন, “টিমের যা অবস্থা তাতে আই লিগে পাঁচের মধ্যে থাকতে পারলেই খুশি হব।” বছর বছর এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায় নিতে হবে কিন্তু কর্তাদেরই। কোচ তাড়িয়ে সেই কলঙ্ক মুছবে না।
এ বারের মোহনবাগান টিম খারাপ এটা বলা যাবে না। ওডাফা-টোলগের পিছনে চার কোটি খরচ করতে গিয়ে বাজেট সামলাতে স্ট্যানলি-ইচের মতো দ্বিতীয় শ্রেণির বিদেশি নিতে বাধ্য হয়েছেন কর্তারা। ফলে টিমের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, এটা যেমন ঠিক। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে অরিন্দম ভট্টাচার্য, রহিম নবি, নির্মল ছেত্রী, জুয়েল রাজা, ডেনসন দেবদাস, খেলেম্বার মতো জাতীয় দলের ফুটবলার রয়েছেন টিমে। কিন্তু তাঁদের সঠিক জায়গায় তো ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু করবেন কে? এখানেই চোনা পড়ে যাচ্ছে প্রতি বছর। টগবগে ঘোড়ার গাড়ির সহিস যদি অনভিজ্ঞ, অপটু হয় তা হলে কী হতে পারে এ দিন তা আরও একবার প্রমাণ হয়ে গেল। |
বিকল্প তিন নাম? |
১) ইগর স্কিভিরিন
২) ডেভিড বুথ
৩) এক জার্মান কোচ |
|
স্নেহাশিস চক্রবর্তীর মতো পজিটিভ লেফট উইং বসিয়ে রেখে স্ট্রাইকার সাবিথকে সেখানে নামিয়ে দিয়েছিলেন মোহন-কোচ। তার উপর রহিম নবির মতো অ্যাটাকিং মিডিওকে লেফট ব্যাক করে দিয়ে ভোঁতা করে দেওয়া হয়েছিল সাপ্লাই লাইন। মণীশ মৈথানি, যাঁর জায়গা সেন্ট্রাল মিডিও তাকে পাঠানো হল রাইট উইং-এ। নিট ফল-শুরু থেকেই ঘেঁটে গেল মোহনবাগানের মাঝমাঠ। সেটাই কাজে লাগালেন প্রয়াগ কোচ সঞ্জয় সেন। কার্লোস হার্নান্ডেজের মতো একজন বিশ্বকাপার তাঁর হাতে। মাঝমাঠে এরকম একটা মারণাস্ত্র থাকলে যা করতে হয় তাই করলেন সঞ্জয়। কার্লোসকে কাজে লাগালেন ফুলঝুরি-পাসার হিসাবে। দু’পায়ে সত্তর-আশি গজের পাস বাড়াতে শুরু করলেন এশিয়া জুড়ে সমীহ পাওয়া কার্লোস। তার সঙ্গে তুলুঙ্গা-ভিনিথের মতো দু’টো টাট্টু ঘোড়া উইং দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। আর শেষে র্যান্টি-ভিনসেন্টরা ঝাপটা দিতে শুরু করতেই মোহনবাগানে বিজয়া দশমী।
গৌরমাঙ্গির দোষে ওডাফা ১-০ করেছিলেন। আট মিনিটের মধ্যে এমন চাপ তৈরি করলেন র্যান্টিরা যে তাড়া খেয়ে নিজের গোলেই বল ঢুকিয়ে দিলেন খেলেম্বা। যদিও ফিফার নিয়ম মানতে রেফারিরা গোলটিকে আত্মঘাতী বলতে চাননি। বলটা যেহেতু প্রয়াগের লেফট ব্যাক সুখেন দে’র গোলমুখী লব ছিল, তাই শ্যামনগরের এই বঙ্গসন্তানকেই গোলের কৃতিত্ব দিয়েছেন ম্যাচ কমিশনার। টিম গড়ার ক্ষেত্রে প্রয়াগ কর্তারা কতটা সঠিক তাঁর প্রমাণ হতে পারেন এই সুখেন। জুনিয়র থেকে সিনিয়রসাত বছর প্রয়াগ টিমে খেলছেন ছেলেটি। গৌরমাঙ্গি- দীপক-অনুপমদের মতো সিনিয়রদের সঙ্গে সুখেনও পাল্লা দিয়ে ওডাফাকে চক্রবব্যূহে বেঁধেছেন। মোহনবাগান টিমে কিন্তু এরকম একজনও চোখে পড়ল না। আই লিগে এখন সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি সঠিক বিদেশি নির্বাচন। প্রয়াগ কর্তারা র্যান্টি মার্টিন্স-কেন ভিনসেন্টের পাশাপাশি মাঝমাঠে সাপ্লায়ার হিসাবে এনেছেন কার্লোসকে। যাঁর অসাধারণ পাস থেকে প্রয়াগের ২-১। ম্যাচের পর প্রয়াগ কোচ সঞ্জয় সেন বলে গেলেন, “এই মোহনবাগান পাঁচের মধ্যে হয়তো থাকবে।”
খুব ভুল বলেননি। টিমের যা হাল তাতে এ বারও ট্রফি পাওয়া কঠিন গঙ্গাপারের ক্লাবের!
প্রয়াগ: সুব্রত, দীপক, গৌরমাঙ্গি, অনুপম, সুখেন, তুলিঙ্গা, কার্লোস (ধনচন্দ্র), আসিফ, ভিনীথ, ভিনসেন্ট (লালকমল), র্যান্টি।
মোহনবাগান: অরিন্দম, নির্মল, ইচে (রাজীব), খেলেম্বা, নবি, মণীশ, ডেনসন, জুয়েল (স্নেহাশিস), সাবিথ (স্ট্যানলি), ওডাফা, টোলগে। |