তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন সরকারের নানা কাজকর্মে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। বিরোধী দল হিসাবে সিপিএমের সভা-সমাবেশে ভিড়ও বাড়ছে। কিন্তু তার মানেই বামেদের দিকে আবার মানুষ ফিরে এসেছেন, এমন মনে করে নেওয়ার সময় এখনও আসেনি। পুজোসংখ্যায় কলম ধরে দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে এমন সতর্ক-বাণীই উচ্চারণ করলেন রাজ্য সিপিএমের দুই শীর্ষ নেতা শ্যামল চক্রবর্তী ও সূর্যকান্ত মিশ্র।
দলীয় মুখপত্রের শারদ-সংখ্যায় সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামলবাবু এ বার বিরোধী আসনে তাঁদের দলের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। আর পলিটব্যুরোর সদস্য সূর্যবাবু বিশ্লেষণ করেছেন দলের মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা। দু’জনের বক্তব্যেই ধরা পড়েছে দলের ভিতরে-বাইরে যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি তাঁরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কর্মীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়িয়ে, দায়িত্বশীল বিরোধীর ভূমিকা পালন করেই সিপিএমকে আরও পথ হাঁটতে হবে।
রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগের পুজো-মরসুমে দুই শীর্ষ নেতার এই হুঁশিয়ারি যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছে বাম মহল। ‘বিরোধী দল হিসাবে আমাদের ভূমিকা’ শীর্ষক নিবন্ধে শ্যামলবাবু বোঝাতে চেয়েছেন, রাজ্যে টানা ৩৪ বছর যখন তাঁরা শাসক ছিলেন, তার বেশির ভাগই কেন্দ্রীয় স্তরে তাঁরা ছিলেন বিরোধী ভূমিকায়। আবার রাজ্যে সরকারে থেকেও কেন্দ্র-বিরোধী অনেক আন্দোলন (যা এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করছেন), এমনকী, ধর্মঘটও সিপিএম করেছে। তার ফলে এক ধরনের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সিপিএমের মধ্যে ছিলই।
দলের ৯০%-এর বেশি সদস্য ১৯৭৭ সালের পরে এসেছেন, এই তথ্য বাস্তব হলেও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার উপাদানকে কাজে লাগানোর প্রবণতা সিপিএমের মধ্যে ছিলই। যা এখন ব্যবহার করতে হচ্ছে মমতার সরকারের বিরুদ্ধে। একের পর এক ঘটনায় মমতার সরকার ও দলের সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গ হচ্ছে বলে দাবি করেও শ্যামলবাবুর হুঁশিয়ারি, ‘কয়েক মাস আগে যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে তৃণমূলকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের অনেকের মধ্যে এক বছরের মধ্যে মমতা সম্পর্কে এত বিতৃষ্ণা এসে যাবে, তা আগে অনেকে ভাবতে পারেননি।...আজ তাঁরা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন বলে যে বামপন্থীদের পক্ষে দাঁড়াবেন, তা কিন্তু নয়। কারণ, বামফ্রন্টের উপর থেকে মানুষের ক্ষোভ এখনও যায়নি। মানুষ যে ভাবে চাইছে, সেই ভাবে পার্টিকে গড়ে তোলা থেকে আমরা এখনও বহু দূরে আছি’। সাংসদ শ্যামলবাবুর মতে, নিজেদের বদলাতে হবে। মানুষের মধ্যে সিপিএম সম্পর্কে ধারণাকেও বদলাতে হবে।
একই সঙ্গে সিটু নেতা শ্যামলবাবু দলের এই অবস্থানেরও পুনরাবৃত্তি করেছেন যে ‘উৎসবে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, দুর্ভিক্ষে, রাজদ্বারে, শ্মশানে যে সঙ্গে থাকবে, সে-ই হল বন্ধু। আমরা বিরোধী দল। কিন্তু সব বিষয়ে অন্ধ বিরোধিতা করতে হবে, এমন তৃণমূল-সুলভ বালখিল্যতার মধ্যে আমরা নেই’! সরকার জনগণের স্বার্থে কোনও প্রস্তাব আনলে তাঁরা সমর্থন করবেন বলেই জানিয়েছেন তিনি।
আবার বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু লিখেছেন, ‘দীর্ঘ সময় জুড়ে সরকারে অবস্থান পার্টির মধ্যে যে সংসদীয় মোহ ও প্রশাসন-নির্ভরশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্র তৈরি করেছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রাজ্যে তৃণমূলের নেতৃত্বে জোট সরকার কায়েম হওয়ার পরে সংসদীয় গণতন্ত্রের উপরে আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এখনও পার্টির মধ্যে এই ঝোঁকগুলি দূর হয়ে যায়নি’। দলের মতাদর্শগত মান যে বর্তমান পরিস্থিতির চাহিদা পূরণের উপযোগী হয়ে ওঠেনি, তা-ও মেনে নিয়েছেন সূর্যবাবু।
এই অবস্থায় পথ খুঁজতে আগামী ১৭ অক্টোবর প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে রাজ্য পার্টি ক্লাসে বসছে সিপিএম। রাজ্য ও জেলা কমিটির নেতারা সেখানে থাকবেন। সমাজতন্ত্র তথা মতাদর্শগত বিষয়ে ওই ক্লাসে পাঠ দেবেন দিল্লির এক অধ্যাপক। জাতি ও জনগোষ্ঠীগত বিষয়ে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করার কথা সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের। |