আগে শুধু পাঠ্যক্রম ঠিক করে দিত মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। বেঁধে দিত বইয়ের পৃষ্ঠা-সংখ্যাও। কিন্তু এ বার ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির সব পাঠ্যবই তৈরি করে দেবে তারাই। ওই দায়িত্ব আর কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকদের হাতে রাখা হবে না। প্রকাশকেরা শুধু ওই বই ছাপার দায়িত্ব পাবেন। রাজ্য জুড়ে স্কুলে স্কুলে পর্ষদেরই বই পড়বে পড়ুয়ারা। এর ফলে প্রতিটি শ্রেণিতে একটি বিষয়ের একটিই বই থাকবে।
আপাতত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে এই ব্যবস্থা। ভবিষ্যতে নবম-দশম শ্রেণিতেও একই ব্যবস্থা চালু হতে পারে বলে জানিয়ে দিয়েছেন পর্ষদ-কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন লেখককে দিয়ে প্রকাশকদের বই লেখানোর রীতিতে পড়বে পূর্ণচ্ছেদ। সরকারের মতে, এতে গোটা রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় সামঞ্জস্য আসবে।
কিন্তু প্রকাশকদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, এতে বিপন্ন হবে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার প্রকাশনা শিল্প। ওই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লক্ষ মানুষের রুজিরোজগারে টান পড়বে। বিভিন্ন প্রকাশন নিছক সরকারি বরাত অনুযায়ী বই ছেপে সরবরাহ করার সংস্থায় পরিণত হবে। এবং সেই সুযোগও পাবে হাতে গোনা দু’চারটি সংস্থা। শিক্ষকদের একাংশ এবং প্রকাশকদের বক্তব্য, সরকার স্কুল স্তরের লেখাপড়ায় সামঞ্জস্যের কথা বললেও এই সিদ্ধান্তের জেরে পড়ুয়াদের পঠনপাঠন বৈচিত্র হারাবে।
মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সম্প্রতি একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির সব পাঠ্যবই তারাই তৈরি করবে। ওই তিনটি শ্রেণির মোট পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা ৩২। তার মধ্যে পর্ষদ নিজেরা ছাপবে ১৩টি। বাকি ১৯টি বই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকদের দিয়ে লিখিয়ে পর্ষদ তার সিডি দিয়ে দেবে প্রকাশকদের। ছাপার দায়িত্ব পেতে হলে প্রকাশনা সংস্থার পরিকাঠামো, তাদের বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ, গত তিন বছরে তারা কোন শ্রেণির কত বই ছেপেছে, কত স্কুলে সেই বই পড়ানো হয়েছে ইত্যাদির বিবরণ পেশ করতে হবে পর্ষদের কাছে। পর্ষদ জানিয়েছে, পরিকাঠামো বিচার করেই প্রকাশনা সংস্থাগুলিকে বই ছাপার বরাত দেওয়া হবে। বই ছেপে জেলায় জেলায় সর্বশিক্ষা মিশনের প্রকল্প অধিকর্তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে তাদেরই। |
এত দিন পর্ষদের পাঠ্যক্রম ও পৃষ্ঠা-সংখ্যা মেনে বিভিন্ন লেখককে দিয়ে বই লেখাতেন প্রকাশকেরাই। সেই বই অনুমোদনের জন্য পর্ষদে জমা দিতে হত। পর্ষদ ছাড়পত্র দিলে তা প্রকাশযোগ্য বলে বিবেচিত হত। তার পরে বইয়ের নমুনা স্কুলে স্কুলে পৌঁছে দিতেন প্রকাশক। স্কুল পছন্দমতো বইটিকে নিজেদের পড়ুয়াদের জন্য নির্বাচন করতে পারত (অঙ্ক ও ইংরেজির ক্ষেত্রে অবশ্য দীর্ঘ কাল ধরে পর্ষদের বই-ই পড়ানো হয়)।
সেই পদ্ধতি এখন বদলানো হচ্ছে কেন?
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “সব ছাত্রছাত্রী যদি একটি বই পড়ে, তা হলে সামঞ্জস্য বজায় থাকবে। এতে তারা উপকৃত হবে।” এক সরকারি কর্তা জানান, সর্বশিক্ষা মিশনে বই কেনার খরচ বাবদ ছাত্র-পিছু বার্ষিক বরাদ্দ ২৫০ টাকা। যে-ব্যবস্থায় এ রাজ্যে এত কাল স্কুলের পাঠ্যবই প্রকাশিত হয়ে আসছে, তাতে ছাত্রছাত্রীদের আরও ১০০ থেকে ২০০ টাকা খরচ হয়। নতুন ব্যবস্থায় তা হবে না। বরাদ্দ টাকার মধ্যেই সব বই পেয়ে যাবে পড়ুয়ারা। তবে প্রকাশকদের বক্তব্য, বরাদ্দের ওই টাকায় সব বই দেওয়া সম্ভব নয়।
ক্ষমতায় এসে নতুন সরকার জানিয়েছিল, পাঠ্যবই তারাই ছাপবে। তাতে প্রকাশকদের বেশির ভাগই আপত্তি তোলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকও করেন তাঁরা। কিন্তু তাতে সমস্যা মেটেনি। লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেন প্রকাশকেরা। তখন শ্রমমন্ত্রী পূণের্র্ন্দু বসুকে মধ্যস্থতা করতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রকাশকেরা শ্রমমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরে ধর্মঘট তুলে নেন। পরে শিক্ষামন্ত্রী ও পর্ষদের কর্তারা প্রকাশকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, “পর্ষদ বই তৈরি করে কিছু বই নির্বাচিত সংস্থাকে ছাপতে দেবে বলেই প্রকাশকদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ছোট-বড় সব সংস্থা এই বন্দোবস্ত মেনে নিয়েছিল।”
বন্দোবস্ত মেনে নিয়ে এখন আপত্তি কেন?
পশ্চিমবঙ্গ পুস্তক শিল্প বাঁচাও কমিটির তরফে শিশিরবিন্দু চৌধুরী বলেন, “সরকার আশ্বাস দিয়েছিল, ছোট প্রকাশকদের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু এখন তো দেখছি, প্রকাশনা শিল্পটাই উঠে যাবে। আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে সমস্যার কথা জানিয়েছি। সরকার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে আমরা আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হব।” প্রকাশকদের বক্তব্য, ছাপার পরিকাঠামো বলতে সবার আগে ছাপাখানার প্রয়োজনের কথা ওঠে। কিন্তু বইপাড়ায় হাতে গোনা কয়েক জন প্রকাশক ছাড়া আর কারও নিজস্ব ছাপাখানা নেই। সেই সব প্রকাশক অন্যের ছাপাখানায় বই ছাপেন। নতুন ব্যবস্থায় তাঁরা বঞ্চিত হবেন। তা ছাড়া পর্ষদই যদি বই লেখে, তা হলে তাঁদের আর প্রকাশনার কাজ থাকবে না। বই ছেপে বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে তাঁদের দায়িত্ব। পাঠ্যবই প্রস্তুত করা থেকে বিক্রি পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে জড়িত প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশকদের একাংশের।
প্রকাশকদের এই আপত্তির ব্যাপারে সরকারের বক্তব্য কী? শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “গোটা বিষয়টাই (আপত্তির ব্যাপারটা) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।” তাঁর দাবি, সরকারের এই সিদ্ধান্তে নোটবইয়ের রমরমাও ঠেকানো যাবে।
শিক্ষকদের অনেকেই অবশ্য এ কথা মানতে রাজি নন। তাঁদের প্রশ্ন, পর্ষদ যে-পাঠ্যবই তৈরি করবে, তারও নোটবই বাজারে আসতে বাধা কোথায়?
ওই শিক্ষকদের বক্তব্য, পর্ষদের সিদ্ধান্ত এক দিকে ছাত্রছাত্রীদের অনুকূল মনে হলেও এর জেরে স্কুলের পঠনপাঠন বৈচিত্র হারাবে। পর্ষদেরই এক প্রাক্তন সভাপতির মতে, বিভিন্ন লেখক বই লিখলে ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে বৈচিত্র আসে। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের জন্য তারও প্রয়োজন কম নয়। তিনি বলেন, “বই যিনিই প্রকাশ করুন, পর্ষদই পাঠ্যক্রম তৈরি করে দেয়। পৃষ্ঠা-সংখ্যা বেঁধে দেয়। কোন অধ্যায়ের জন্য ক’টি ক্লাস, তা-ও নির্দিষ্ট করে দেয়। পর্ষদের অনুমোদন না-পেলে কোনও বই-ই ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছয় না।” |