নেই তাই বাড়তি।
শিল্প নেই। তাই কেনার লোকও নেই। আর সে জন্যই রোজ গড়ে সাড়ে পাঁচশো মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাড়তি হচ্ছে রাজ্যে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই বাড়বাড়ন্তর কথা স্বীকার করলেন রাজ্যের বিদ্যুৎসচিব মলয় দে স্বয়ং। এবং সেটা যে সমস্যার, তা-ও কার্যত মেনে নিয়েছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত সরাসরি মানতে চাননি, শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার অভাবেই এই বেহাল অবস্থা। যদিও তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনিও বলেন, “রাজ্যে বিদ্যুৎ নির্ভর শিল্প ক্রমশ কমছে। তাই শিল্পে বিদ্যুৎও কম লাগছে।” যার অর্থ দাঁড়ায় একটাই, শিল্প নেই। তাই এই বাড়তির বোঝা।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী পর্যায়ে শিল্পায়নের গতি থমকে গিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে শিল্পবন্ধু ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার যতই চেষ্টা করুক, তাদের জমি-নীতিও এই পথে বড় বাধা বলে জানিয়েছে শিল্পমহলের একটা বড় অংশ। বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎসচিব যা বললেন, সেটা এই পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মলয়বাবু বলেন, “রাজ্যে বিদ্যুতের কোনও অভাব নেই। বরং দিনের বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার তুলনায় ৫৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত কম উৎপাদন করতে হয়।” বিদ্যুৎসচিবের ব্যাখ্যা, “চাহিদার এই সমস্যা শুধু এ
|
মণীশ গুপ্ত,
বিদ্যুৎমন্ত্রী |
রাজ্যের নয়। উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ অন্য রাজ্যেও বিক্রি করা যাচ্ছে না।” রাজ্যে কেন বিদ্যুতের চাহিদা যথেষ্ট নয়, সেই ব্যাখ্যা অবশ্য মলয়বাবু দেননি।
আলোচনাসভার পরে মলয়বাবু বলেন, ২০১০-১১ সালে দিনে সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ হারে। ২০১১-১২ সালেও চাহিদা বৃদ্ধির হার ওই একই জায়গায় থেকে গিয়েছে। পরপর দু’বছর চাহিদা বৃদ্ধির হার কেন একই জায়গায় থমকে রয়েছে, সে ব্যাখ্যাতেও যাননি মলয়বাবু।
শিল্পমহল অবশ্য বলেছে, চাহিদা বৃদ্ধির হার থমকে যাওয়ার প্রধান কারণ রাজ্যে শিল্পায়ন থমকে যাওয়া। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী বছর ভরা গ্রীষ্মে রোজ গড়ে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত হবে বলে হিসেব কষে দেখেছে বিদ্যুৎ দফতর। আর তা হলে বড় সমস্যায় পড়বে রাজ্য সরকার। কারণ, সে ক্ষেত্রে বাড়তি বিদ্যুতে কাটছাঁট করতে উৎপাদন কমাতে হবে। ফলে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রই বন্ধ রাখতে হতে পারে। প্রশ্ন উঠেছে, কাজই যদি সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তা হলে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির মাথার উপরে যে ধারবাকির বোঝা রয়েছে, তা মেটানো হবে কী ভাবে?
এখানেই শেষ নয়। রাজ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় গতি আসবে মনে করে ২০০৭ সালে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল। সেখানে পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির সংস্কারের পাশাপাশি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার উদ্যোগও নেওয়া হয়। বিদ্যুৎ দফতর সূত্রের খবর, লক্ষ্য ছিল, দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী যোজনার মধ্যে (২০১২-২০১৭) নতুন কেন্দ্র ও সংস্কারের সব কাজ শেষ করে ফেলা।
এর ফলে কোথায় নতুন উৎপাদন শুরু হবে? বিদ্যুৎ দফতর সূত্রের খবর, মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে ৫০০ মেগাওয়াট করে যে দু’টি ইউনিটের কাজ চলছে, ২০১৫ সালের মধ্যে সেগুলিতে উৎপাদন শুরু হবে। ওই সময়েই উৎপাদন শুরু করবে ডিপিএল-এর ২৫০ মেগাওয়াটের আরও একটি ইউনিট। পাশাপাশি ব্যান্ডেলের ২১০ মেগাওয়াটের ইউনিটটির সংস্কারও ওই সময়ের মধ্যে শেষ হবে। এ ছাড়া, হলদিয়ায় সিইএসসি-র ৬০০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ওই সময়ের মধ্যে চালু হয়ে যাবে। ফলে এখন রাজ্য সিইএসসি-কে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দেয়, তারও প্রয়োজন পড়বে না। সব মিলিয়ে, ২০১৫-১৬ সালে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি দাঁড়াবে তাতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে রাজ্যে। রাজ্যের এক বিদ্যুৎ কর্তা বলেন, “হিসেব করে দেখেছি, ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত দিনের সর্বাধিক চাহিদার সময়েও রাজ্যে গড়ে ১১০০-১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকবে।” |
আলোয় আঁধার |
|
২০১৩-১৪ |
২০১৪-১৫ |
২০১৫-১৬ |
গরমে চাহিদা |
৮৩৬২ |
৯১৪১ |
৯৯৯৬ |
সরবরাহ ক্ষমতা |
৮৮২৩ |
৯৪০২ |
১০২১৩ |
* হিসেব মেগাওয়াট প্রতিদিন |
সূত্র: বিদ্যুৎ দফতর |
|
এই বাড়তি বিদ্যুৎ কোন কাজে লাগবে, তার দিশা এখনও খুঁজে পায়নি বিদ্যুৎ দফতর। অন্য রাজ্যে বিদ্যুৎ বিক্রির চেষ্টা করতে হবে তাঁদের। কিন্তু তা এখনই সম্ভব নয়। বিদ্যুৎসচিবও সে কথা মেনে নিয়েছেন। তা হলে? ঘুরেফিরে এসেছে সেই একই আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত বসিয়ে রাখতে হতে পারে বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে। তাই সেগুলি নির্মাণের জন্য যে বিপুল ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তা কী ভাবে শোধ দেওয়া হবে তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে বিদ্যুৎ-কর্তাদের
কেন বলা হচ্ছে, শিল্পায়ন প্রক্রিয়া বাধা পাওয়ায় বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের এই হাল? বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, ২০১১-১২ আর্থিক বছরে রাজ্যে যেখানে গড়ে কমপক্ষে ৮ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে বলে ধরা হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়েছে মোটে ৪ শতাংশ। শিল্প কম হওয়ার ফলেই যে এমন অবস্থা, সে কথা মেনে নিয়েছেন অনেকেই।
যদিও বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত এ কথা মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, “উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের সঙ্গে রাজ্যের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা ভিত্তিহীন তত্ত্ব। শিল্পে তো লাগে মাত্র ১০% বিদ্যুৎ। বছরে শিল্পে বৃদ্ধির হার ২ থেকে ৩ শতাংশ। কিন্তু রাজ্য এমন ভাবে পরিকল্পনা করে রেখেছে যে, ২০২০ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উদ্বৃত্তই থাকবে।” তিনি এ-ও দাবি করেছেন, এক বছরে ২৪ লক্ষ বিদ্যুৎ গ্রাহক বেড়েছে রাজ্যে। তা হলে এত বাড়তি বিদ্যুৎ কেন? তখন ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সেই মণীশবাবু আবার বলেন, “রাজ্যে বিদ্যুৎ নির্ভর শিল্প ক্রমশ কমছে। তাই শিল্পে বিদ্যুৎও কম লাগছে।” তাঁর এই কথার মধ্যেই স্ববিরোধিতা আছে বলে মনে করছে শিল্পমহলের একটা বড় অংশ।
বাম আমলে গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল নিত্যকার ছবি। বিদ্যুৎ সংস্কারের পরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। সে কথা উল্লেখ করে রাজ্যের প্রাক্তন বিদ্যুৎমন্ত্রী নিরুপম সেন বলেন, “২০০৬ সালের পর থেকে বিদ্যুতের চাহিদা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। তার মূলে গ্রামীণ বিদ্যুদয়নে গতি এবং শিল্পায়ন। বর্তমানে শিল্পে যেমন মন্দা এসেছে, তেমনই গ্রামীণ বিদ্যুদয়নও গতি হারিয়েছে। তাই এত বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত হচ্ছে।” |