লড়াইটা কখনও নিজের সঙ্গে, কখনও একমাত্র ছেলের জন্য, আবার কখনও সেই লড়াইটা সবচেয়ে কাছের মানুষের বিরুদ্ধেই। আর এই লড়াইয়ের প্রথম পাঠটা তিনি বাবার কাছেই পেয়েছিলেন। বাবার কথা উঠতেই চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নবদ্বীপ বঙ্গবাণী গার্লস হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা মঞ্জু সরকারের। বাবা ছিলেন মহাত্মা গাঁধীর একনিষ্ঠ ভক্ত ও স্বাধীনতা সংগ্রামী।
মঞ্জুদেবী বলেন,‘‘আমরা চার ভাই বোন মা মাঝেমধ্যেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে বিছানাবন্দি হয়ে পড়তেন। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব এসে পড়ত আমার উপরেই। খুব মনে আছে, তখন আমার বয়স বড় জোর এগারো। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। আমি দিদি, ভাইদের খাইয়ে তাদের জন্য স্কুলের টিফিন তৈরি করে তারপর পরীক্ষা দিতে যেতাম।’’
তারপর এক এক করে হায়ার সেকেন্ডারি, স্নাতক হওয়া এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ পাশ। |
মঞ্জুদেবীর কথায়,‘‘এম এ পাশ করার কয়েক মাস পরেই নবদ্বীপ তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ে অস্থায়ী শিক্ষিকার চাকরিও পেয়ে গেলাম। বুঝতে পারিনি নিজের অজান্তেই কখন অন্য এক লড়াইয়ের জগতে ঢুকে পড়েছি। প্রায় সাড়ে চার বছর সেখানে অস্থায়ী শিক্ষিকা হিসাবে চাকরি করার পর নানা কারণে স্থায়ী হলাম না। শেষপর্যন্ত সিউড়ির কালীগতি উইমেন্স মেমোরিয়াল কলেজে চাকরি পেলাম।’’
চাকরির পরেই বিয়ে, সংসার, সন্তান। কিন্তু সেই সংসার-যাত্রা মসৃণ হয়নি। মঞ্জুদেবী বলেন, ‘‘এই সময়ে আমাকে কলকাতায় গিয়ে বি এড ট্রেনিং নিতে হয়। তখন আমার ছেলের বয়স মাত্র চোদ্দ মাস। মনে আছে ভোর পাঁচটায় নবদ্বীপ থেকে ট্রেন ধরতাম। ছেলে তখন ঘুমোচ্ছে। রাত এগারোটায় যখন ফিরতাম তখনও ছেলে ঘুমোচ্ছে। তখন তো এত ট্রেন ছিল না।’’ তারপর সংসার ভেঙে যাওয়া, একা ছেলেকে মানুষ করার পাশাপাশি শিক্ষকতা। এসব নিয়েই তাঁর জীবন এক অন্য খাতে বইতে থাকে। সেসব দিনের কথা বলতে গিয়ে মঞ্জুদেবী বলেন, ‘‘নানা রকমের সামাজিক, পারিবারিক অসম্মান সব মুখ বুঁজে সহ্য করেছি। বুঝতেই পারছেন ছেলে তখন বয়ঃসন্ধিতে। তার হাজার প্রশ্ন। আমি শুধু সে সব কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর হাতড়ে বেড়িয়েছি।’’ তারপর আপন মনেই বলে চলেন,‘‘সব প্রশ্নের উত্তর কি আমি নিজেও পেয়েছি?’’
১৯৯৭ সালে আবারও একটা বাঁক। বীরভূমের সিউড়ি থেকে নদিয়ার বগুলার একটি স্কুলে তাঁকে প্রধানশিক্ষিকার দায়িত্ব নিতে হয়। কিন্তু দু’বছরের মধ্যে সে দায়িত্ব ছেড়ে পুনরায় ফিরে যেতে হয় পুরনো স্কুলেই। এরপর ২০০৪ সালে এসএসসি দিয়ে নবদ্বীপের বঙ্গবাণীতে। তাঁর কথায়,‘‘এখানে এসে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। নতুনকে মেনে নিতে আমাদের যে সহজাত আপত্তি তারই মুখোমুখি হলাম। স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে নানারকম অভিজ্ঞতা হল। তারমধ্যে স্কুল সংক্রান্ত আইনি সমস্যাও ছিল। তবে সব লড়াই কি আর শেষ হয়?’’ |