পাহাড়ি ‘জরিবুটি’র তোড়? না কি ‘জয় হো পঞ্চবটি’র জোর?
পাহাড়ের কোলে ইস্টবেঙ্গলের বিজয়-রহস্য নিয়ে জোরালো তর্ক হতে পারে! কিন্তু বাস্তবে, ইউনাইটেড সিকিমকে পাহাড় থেকে সমতলে টেনে নামাতে গিয়ে অস্ত্র-ভাণ্ডারের সব মুখ খুলে দিতে হল ট্রেভর মর্গ্যানকে।
কেরামতিতে কোন ফুটবলার ‘ওস্তাদো কা ওস্তাদ’?
তাবড় তাবড় ফুটবল-বিশেষজ্ঞের চুল ছেঁড়া আলোচনায় বহু তত্ত্বকথা বেরিয়ে আসবে। পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় কিন্তু সেরা ফুটবলার খোঁজার সহজতম রাস্তা একটাই। যে ফুটবলার বিপদের সময় দলের রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারবেন, তিনিই দক্ষ ফুটবলার। হতে পারে নামী-দামি তারকাদের ভিড়ে নব্বই মিনিটের ম্যাচে মাত্র কুড়ি মিনিট খেলার সুযোগ থাকে। তাতে কী? মোক্ষম সময়ে একটা গোল করে বুঝিয়ে দেন, তিনিই বিপদের ‘মুশকিল আসান’। মিজোরামের ‘পাহাড়ি বিছে’ লালরিন্দিকা রালতের ফ্রি কিক দিয়েই আই লিগে ‘জয় হো’ অভিযান শুরু ইস্টবেঙ্গলের।
কেরামতিতে কোন কোচ ‘ওস্তাদো কা ওস্তাদ’?
তাবড় তাবড় ফুটবল-বিশেষজ্ঞদের চুল ছেঁড়া আলোচনায় বহু তত্ত্বকথা বেরিয়ে আসবে। পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় কিন্তু সেরা কোচ খোঁজার অতি-সহজতম রাস্তা একটাই। যে কোচের দল বিরতির পরে ভাল খেলবে, তিনিই দক্ষ কোচ। কেননা বিরতির আগে বিপক্ষকে আপাদ-মস্তক মেপে নিয়ে ইন্টারভেলের পরে পাল্টা চাল দিতে পারবেন। ছোট মাঠ। বল হোল্ড করার সময় নেই। মাঝমাঠ অস্তিত্বহীন। খেলার চাকা গড়াচ্ছে শুধু রক্ষণ আর ফরোয়ার্ডের দাপাদাপিতে। এই পরিস্থিতি থেকে দলকে টেনে তোলার মন্ত্র কী? এখানেই ফিলিপ ডি’রাইডারের উপরে মর্গ্যানকে রাখতে হচ্ছে। বিরতির পরে দুই পাহাড়ি বিছে লালরিন্দিকা ও সঞ্জু প্রধানকে নামিয়ে ট্যাকটিক্যাল যুদ্ধে বিপক্ষকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বিশেষ করে যখন দেখলেন স্ট্রাইকারদের দিয়ে গোল হওয়ার সম্ভাবনা কম, তখন ‘রিটার্ন বল’ দিয়েই ‘জ্যাকপট’ খুললেন লাল-হলুদ কোচ। |
লালরিন্ডিকা: সিকিম বধের নায়ক। |
ইস্টবেঙ্গল যে ভাবে ইদানীং বিরতির পরে জেগে উঠছে, তাতে মর্গ্যানের কোচিং দক্ষতাকে অভিবাদন করতেই হবে। প্রতি ম্যাচে তারা গোলের খিড়কি খুলছে দ্বিতীয়ার্ধে। গ্যাংটকে পাহাড় বনাম সমতলের যুদ্ধেও তাই হল। ম্যাচের পরে মর্গ্যান বলছিলেন, “মাঠে এত গতিতে বল ছুটছিল যে নিয়ন্ত্রণ করতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। এ সব ম্যাচে প্রচণ্ড সতর্ক ভাবে খেলতে হয়। ধৈর্য হারালে চলবে না।”
ভাইচুংয়ের দল এ দিন শুরুটা ভালই করেছিল। ইস্টবেঙ্গল ফুটবলাররা বল ধরলেই ট্যাকল প্রথায় বিশ্বাসী। সব সময় চিডি-পেনদের পিছনে বাড়তি পাহারাদার। ছটফটে নুরুদ্দিনকে সামনে রেখে সাফ-সুতরো স্কোরলাইনের দিকে এগোচ্ছিল সিকিমিজরা। কিন্তু মোক্ষম সময়ে বেশ কিছু ফুটবলার চোট-আঘাতের কবলে পড়ে যাওয়ায়, দুরন্ত কাউন্টার অ্যাটাকগুলো হচ্ছিল না। যেটা সালগাওকর ম্যাচে ভীষণ কাজে দিয়েছিল। ম্যাচের পরে সিকিম কোচ রাইডার বলছিলেন,“ফুটবলে জেতা-হারা আছেই। হ্যাঁ, আমরা যদি খারাপ খেলে হারতাম, তা হলে কষ্ট হত। কিন্তু ফুটবলারদের পারফরম্যান্সে আমি খুশি। ফলাফলের ওপর তো আমার নিয়ন্ত্রণ নেই।” আশি মিনিট পর্যন্ত দল কিন্তু ফোকাস হারায়নি।
ফোকাস ঠিক রাখার জায়গাতে ইস্টবেঙ্গল যে এক কাঠি উপরে, তা দেখালেন মেহতাবরা। বলজিতের মতো ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ফুটবলারকে তুলে এই বাজারে সঞ্জু প্রধানকে নামানো মারাত্মক ঝুঁকি। কিন্তু সঞ্জুকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার জন্যই গোলের দরজা খুলল। মানব-প্রাচীরের ওপর দিয়ে যে ভাবে ঠান্ডা মাথায় লালরিন্দিকা গোলে বল রাখলেন, সেটা এক কথায় অনবদ্য। কেননা তার আগে এত অবিশ্বাস্য গোল নষ্ট হয়েছে যে আত্মবিশ্বাসই ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। “ফুটবলারদের ক্লান্তি নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলাম। আমার চেষ্টা ছিল, ফুটবলারদের যতটা রিল্যাক্সড রাখা যায়।” মর্গ্যান তাঁর লক্ষ্যে সফল।
ইস্টবেঙ্গলের এই অনন্য ধারাবাহিকতার রসহ্য কী? বিশেষজ্ঞদের মতে, মর্গ্যানের ‘শৃঙ্খলা-বোধ’-ই দলের ‘জয় হো’ মন্ত্র। আর সেটার জোরেই খামের সঙ্গে ডাকটিকিট লেগে থাকার মতো জয় লেগে আছে লাল-হলুদের গায়ে! বৃহস্পতিবারের ম্যাচে মর্গ্যানের প্রত্যেকটা ‘মাস্টার্সস্ট্রোক’ অদ্ভুত ভাবে কাজ করে গেল। ওপারা-অর্ণবের ডিফেন্সিভ নৈপুণ্য। দুই সাইডব্যাক সৌমিক, নওবার ওভারল্যাপিংয়ে সামঞ্জস্য। মাঝমাঠে পেন-মেহতাবদের বাড়তি তাগিদ। দুই সাইড হাফ হরমনজিৎ, ইসফাকের দৌড়। ফিটনেসের চূড়ায় বলে বিরতির পরে দলটার অবলীলায় গতি বাড়ানো। সেট পিসে সাফল্য। কর্নার, ফ্রি কিক, থ্রো ইনে ভয়ঙ্কর। সব ভালর মধ্যে শুধু একটাই আশঙ্কা থেকে গেল অভিজিৎ মণ্ডলের কুঁচকির চোট নিয়ে। গোলকিপার কোচ অতনু ভট্টাচার্য অবশ্য বললেন, “ভয়ের কোনও কারণ নেই।”
বৃষ্টির গ্যাংটকে বিকেল পাঁচটার সময় চিডি-মেহতাব-পেনদের দেখার জন্য আকুল ভিড়। ক্যামেরার ঝলসানি। রাতে আবার ভাইচুংয়ের নৈশভোজের ‘গ্র্যান্ড-পার্টি’। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি কোথায়? কলকাতায় ফিরেই ‘আবার চল ক্লাব নিকেতন’ গাইতে হবে না। ক্লান্তি কাটাতে মর্গ্যানের ক্লাস আপাতত এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ।
ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ (গুরপ্রীত), সৌমিক, অর্ণব, ওপারা, নওবা, পেন, মেহতাব, হরমনজিৎ, ইসফাক (সঞ্জু), বলজিৎ (লালরিন্ডিকা), চিডি। |