এই প্রথম কলকাতায় যাবে মাইকেল। সেই অক্সফোর্ডে পড়ার সময় থেকেই সহপাঠী জয়ের মুখে শোনা সেই কলকাতায়। যে শহরটাকে জড়িয়ে রাখে অদ্ভুত এক উষ্ণতা বন্ধুত্বের, ভালবাসার, সম্পর্কের উষ্ণতা। যেখানকার মানুষ অনেক দুঃখ, অনেক সমস্যা সত্ত্বেও হাসিখুশি থাকে যতটা পারে। জয় বলেছে ‘দুর্গাপূজা ফেস্টিভ্যাল’-এর সময় যেতে। ওই চারটে দিনে আলোয়, রঙে, আনন্দে শহরটা যেন আরও ঝলমল করে। তাই তো ঠিক সেই সময়টাতেই যাচ্ছে মাইকেল। বান্ধবী অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে।
জয়ের বাড়ি বালিগঞ্জে, মানে সাউথ কলকাতায়। ওই পাড়াটার আশপাশেই নাকি দারুণ সব পুজো হয়। গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে সিংহি পার্ক যেমন। এ বার সেখানে মণ্ডপটা হবে সাউথ ইন্ডিয়ার মীনাক্ষি আম্মান টেম্পলের মতো। আসল মন্দিরের মতোই মণ্ডপের ভিতরটাও সাজবে বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিতে। এ পুজোর বরাবরের ঐতিহ্য সাবেক প্রতিমা। এ বারও তাই মণ্ডপে ঝলমল করবে ২৩ ফুটের একচালা দেবী প্রতিমা। জয় বলেছে ইন্ডিয়ায় নাকি এখনও গার্ল চাইল্ডকে মেরে ফেলা হয়। তাদের বাঁচিয়ে রাখার ভাবনাতেই এ বার এই পুজোয় যাবতীয় কাজকর্ম এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকছেন শুধু মহিলারাই। এই পুজোয় নাকি আলোর খেলাও দেখার মতো। চন্দননগরের আলোয় এ বার থাকছে বাচ্চাদের খেলনাপাতি।
সেলিমপুর পল্লি স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাবের পুজোয় এ বার শরতের সাজ। নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। মাটিতে মাথা দোলাচ্ছে কাশফুলের দল। শিউলির গন্ধে ম ম চারপাশ। খবর পেয়ে এসেছে ভ্রমরও। দেবীর বন্দনায় প্রকৃতিও কেমন করে সেজে ওঠে, দেখার অপেক্ষায় আছে মাইকেল।
পাশেই সেলিমপুর ক্লাবের থিমে এ বার নাচের ভাষা। শিবের তাণ্ডবনৃত্য থেকে রাধাকৃষ্ণের মিলন, স্বর্গের অপ্সরা মেনকা-উর্বশীর নাচের আবেদনসবই থাকছে এ পুজোর ভাবনায়। তবে মূলত এ পুজোর উপস্থাপনা ধরছে শিবেরই ১০৮টি নৃত্যভঙ্গী। আর এই প্রতিটি নৃত্যভঙ্গীই সাজছে পরিবেশ-বান্ধব খেজুরের ছাল, তালপাতা, ধুঁধুলে। মণ্ডপসজ্জায় থাকছে পদ্ম-সরোবরও। ইন্ডিয়ান ডান্সের গল্প বলেছিল জয়। নাচের ছন্দে, তালে এই পুজোটা দেখতে অ্যাঞ্জেলারও তাই খুব উৎসাহ।
রাসবিহারী অ্যাভিনিউ থেকে একটু ভিতরে পরাশর নবোদয় সঙ্ঘ। ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরের আদলে গড়া দক্ষিণ কলকাতারই এক হিন্দু মন্দিরের শিখরের অনুকরণে তৈরি হচ্ছে এ পুজোর মণ্ডপ। ভিতরে থাকবে নানা পেন্টিং ও কারুকাজ। বরাবরের মতোই পুরাণ অনুসারে প্রতিমার রূপ। ডাকের সাজে সোনার গয়নায় সাজবেন দেবী। জয়ের মামার বাড়ি ওই পাড়াতেই। বলেছে, এই পুজোটা দেখিয়ে আনবে ওদের।
কাছাকাছি রাজা বসন্ত রায় রোডে সুহৃদ সঙ্ঘের থিম এ বার ‘আমার বাংলা, আমিই গড়ি’। যেখানে নিজের হাতে নিজের মতো করেই মণ্ডপ সাজিয়ে নিতে পারবেন দর্শনার্থীরাই। কারণ, মূল মণ্ডপে ঢোকার মুখে দু’পাশের দেওয়ালে থাকছে গ্রাম-শহরের নানা দৃশ্য। সেই দৃশ্যের প্রতিটি বস্তু বা ব্যক্তির ভাস্কর্য ইচ্ছেমতো এখানে ওখানে সরিয়ে দর্শনার্থীরাই নিজের মতো করে ফের সাজিয়ে নিতে পারবেন মণ্ডপ। খানিকটা জিগ্স পাজলের মতো হবে কি? না ‘মেক অ্যান্ড নো’-র মতো? এই থিমটার গল্প শুনে বেশ লেগেছে মাইকেলের। অন্য রকম।
গার্ডেনরিচে মুদিয়ালী হরিভক্তি প্রদায়িনী সভার পুজোটার এ বার ১১১তম বছর। তাদের মণ্ডপও এ বার স্বর্ণ মন্দিরের আদলে। মাইকেলরা তো পুজোই দেখেনি কখনও। সেখানে এত পুরনো পুজো দেখার লোভ কি সামলানো যায়!
চক্রবেড়িয়া সর্বজনীনে আবার মায়াবী এক জগত। দেবী বন্দনার পুরোটাই যে মায়া। সেই অধরা ভাবনাকে সাজিয়েই পুজোয় মাতে গোটা বাংলা। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা শক্তিকে ছুঁতে চায়। অনুভবে স্বপ্নে দেখে সেই মায়ার খেলা।
আসলে জয়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতে কলকাতাটাকেই কেমন মায়াবী লাগে মাইকেলের। অ্যাঞ্জেলারও। সুদূর লন্ডনের ঝাঁ-চকচকে অ্যাপার্টমেন্টে বসে দু’জনেই তাই প্রহর গোনে। আর তো মোটে ক’টা দিন। তার পরেই সত্যি সত্যিই গিয়ে দাঁড়াবে উৎসবের রং মাখা শহরটায়! |