‘গুড আর্থ’-এর লেখিকা পার্ল বাক নন। তিনি ইংরেজি লেখা মার্কিন। ‘সোল মাউন্টেন’-এর লেখক গাও ঝিংজিয়ান-ও নন। তিনি দেশত্যাগী, ফরাসি নাগরিক।
মো ইয়ান-এর নোবেলকেই দেশের জন্য প্রথম নোবেল সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে চিন। ২০১০-এ যখন লিউ জিয়াওবো নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন, তখনও নোবেল পুরস্কারকে অগ্রাহ্য করার রাস্তাই নিয়েছিল তারা। বেজিং কারাগারে বন্দি মানবাধিকার কর্মী লিউকে পুরস্কার নিতে যেতে দেওয়া হয়নি। আজ সেই চিনই ‘দুনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত সাহিত্য পুরস্কার’ বলে বর্ণনা করল নোবেল সাহিত্য পুরস্কারকে। উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়ায় তারা বলল, ‘শতাধিক বছরের বেশি সময় ধরে সাহিত্যে দুনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত এই পুরস্কারটি চিনের কেউ পাননি। এ বারে সেই ধারাটায় দাঁড়ি পড়ল।’
তিরিশের দশকে ‘গুড আর্থ’, ‘সন্স’ এবং ‘আ হাউস ডিভাইডেড’ এই উপন্যাসত্রয়ীর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব চিনের কৃষক জীবনকাহিনিকে অমরত্ব দিয়েছিলেন পার্ল এস বাক। জন্মসূত্রে মার্কিন হলেও পার্লের জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছিল চিনে। তবু ‘বিদেশিনি’ বলেই কি পার্লের নোবেলকে নিজের বলে মানল না চিন, প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে গাও ঝিংজিয়ান-কে নিয়েও। বেশি দিন আগেও নয়, একুশ শতকের গোড়াতেই নোবেল পান গাও। কিন্তু তিনিও তো দেশত্যাগী। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় একদা প্রাণে বাঁচতে স্যুটকেস ভর্তি পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে ফরাসি নাগরিক। কমিউনিস্ট চিন স্বভাবতই আপন ভাবেনি তাঁকেও। ২০১০-এ যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন, সেই লিউ জিয়াওবো তো চিনা রাষ্ট্রের ঘোষিত সমালোচক! রাষ্ট্রের কারাগারে বন্দি! |
সেখানে মো ইয়ান? চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য! চিনের সরকারি ‘রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি! লিউ জিয়াওবো-র নোবেল পুরস্কারকে স্বীকার করেননি এই মো ইয়ান-ও। এমনকী দেশত্যাগী এবং রাষ্ট্রবিরোধী কিছু লেখক উপস্থিত থাকবেন জেনে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাতেও এক বার সামিল হননি। এত দিনে নোবেল-তালিকায় ঘরের লোককে পেল ‘পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না’।
ঘরের লোক বটে। কিন্তু মো ইয়ান কি তবে চিন সরকার ও প্রতিষ্ঠানের নেকনজরে থাকা এক জন লেখক? ভুল! নোবেল কমিটি এ দিনও উল্লেখ করেছে মো-র ‘গার্লিক ব্যালাডস’ উপন্যাসের কথা। ‘স্বর্গরাজ্য’ বা ‘প্যারাডাইস কাউন্টি’ নামে চিনের এক রাজ্যে অফিসারেরা জানিয়ে দিয়েছেন, এ বছর শুধু রসুন চাষ করতে হবে। কিন্তু তার পর চাষিদের টাকায় পকেট ভারী করে আমলারা হঠাৎ ঘোষণা করল, গুদামে আর রসুন নেওয়া যাবে না। সব ভর্তি। আশির দশকের শেষে চিনে এই উপন্যাস কিন্তু নিষিদ্ধ হয়েছিল। পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। একদা নিষিদ্ধ হয়েছিল তাঁর ‘বিগ ব্রেস্টস অ্যান্ড ওয়াইড হিপ্স’ উপন্যাসও। রাজতন্ত্রে শানগুয়ান লু নামে একটি মেয়ের গর্ভে সাত কন্যা জন্মায়। তাদের কারও নাম ‘ছেলে আসছে’। কারও নাম ‘ছেলের অপেক্ষায়।’ কারও বা নাম ‘ছেলে চাই’। শেষে এক সুইডিশ ধর্মযাজকের ঔরসে শানগুয়ানের ‘সোনালি ছেলে’ নামে একটি শিশুপুত্র হয়। উপন্যাসের সাতটি অধ্যায় রাজতন্ত্র থেকে
শুরু করে মাও-পরবর্তী চিন, এই বিশাল সময়কালের সাতটি পর্ব। ওটিই তাঁর অন্যতম প্রতিনিধিত্বমূলক উপন্যাস।
২০১২-র নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য গত ক’দিন ধরে ইন্টারনেটে যে দু’টো নাম সবচেয়ে বেশি ভাসছিল, তার মধ্যে ৫৭ বছরের মো অবশ্য ছিলেন না প্রথমে। মার্কিন গায়ক বব ডিলান ও জাপানের লেখক হারুকি মুরাকামিই ছিলেন সম্ভাব্য ফেভারিট। কিন্তু বুধবার থেকে কিছুটা বেনজির ভাবেই সর্বশক্তি দিয়ে সাইবারস্পেসে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিনের সরকারি ওয়েবসাইট www.china.org.cn এবং সরকারি সংবাদমাধ্যম জিনহুয়া। ‘সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার চিনের হাতে এখনও আসেনি, সুইডিশ অকাদেমির বিচারে মো ইয়ান জিততে পারেন ভেবেই আমরা রোমাঞ্চিত,’ জানিয়েছিল তারা।
বইপত্র, শিল্পসাহিত্য সংক্রান্ত পুরস্কার নিয়ে যে ‘সফ্টপাওয়ার’ রাজনীতি চলে, সাধারণত রাষ্ট্র তাতে এত প্রত্যক্ষ ভাবে তার উপস্থিতি ঘোষণা করে না। প্রভাব-প্রতিপত্তি-ক্ষমতার অঙ্কটা কষা হয় নিভৃতে। চিন এ ভাবে সরাসরি ঝাঁপানোর পর থেকেই তাই যুদ্ধের উত্তেজনা শুরু। বৃহস্পতিবার সুইডিশ সময় দুপুর ১টায় (ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে ৪টা) পুরস্কার ঘোষণা। বিভিন্ন ব্লগ এবং ওয়েবসাইটে তার আগেই কাউন্টডাউন শুরু, ‘আর এক ঘণ্টা।’ তার পরে ‘সভাঘরের দরজা বন্ধ। সিদ্ধান্ত আর কিছু ক্ষণ পরেই।’ তত ক্ষণে আট হাজার চিনা নাগরিক অনলাইন ভোটে জানিয়েছেন, মো-কেই তাঁরা এক নম্বরে রাখছেন।
ভারতীয় সময় বিকেল ৪টে ৩১। সুইডিশ অকাদেমির স্থায়ী সচিব পিটার ইংলুন্ড জানালেন, ‘মো ইয়ান-ই এ বার সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত। উপকথা, ইতিহাস এবং সমসাময়িক বাস্তবকে যে আলো-আঁধারি বিভ্রমে উপস্থাপন করেন তিনি, তার জন্যই এই সম্মান।’
আশির দশকে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নোবেলপ্রাপ্তির সময় ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ কথাটা শোনা গিয়েছিল। এ বার শোনা গেল, ‘হ্যালিউসিনেটরি রিয়ালিজ্ম’। নামে কী আসে যায়! মো ইয়ান মাস দুয়েক আগে ‘গ্রান্টা’ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, মার্কেজ ও ফকনার তাঁর অন্যতম প্রিয় লেখক। গার্সিয়া মাকের্জের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’-এর মতোই বাস্তবের কুহকে চিনের সমাজ ও ইতিহাসকে মুড়ে রাখেন মো।
চিনা ভাষায় মো ইয়ান মানে, ‘কথা বলো না’। ছদ্মনাম। সেনাবাহিনীতে থাকতে থাকতেই উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন গুয়ান মোয়ি। সেনাকর্তাদের চোখ এড়াতে ওই ছদ্মনাম।
চিন-জাপান যুদ্ধের পটভূমিতে চিনা কৃষকদের বিদ্রোহ নিয়ে মো-র উপন্যাস ‘রেড সরঘুম’ অবলম্বনেই ঝাং ইমোউ-এর বিখ্যাত ছবি। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়েছিল ছবিটি।
গত মাসে বেজিং-এ মাও দুন সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে মো-র নতুন উপন্যাস ‘ফ্রগ’। চিনের সবচেয়ে দামি সাহিত্য পুরস্কার, চার বছর অন্তর দেওয়া হয়। ‘এই মহৎ সময়ের উপযোগী মহৎ উপন্যাস এখনও লেখা হয়নি। সেই উপন্যাস আমাকে ডাকছে বুঝতে পারি, কিন্তু রাস্তাটা এখনও পরিষ্কার নয়,’ তখন বলেছিলেন মো।
আজ? নোবেল প্রাপ্তির পর? মো-কে মোবাইলে পাওয়াই যায়নি সারা দিন। মো-র প্রকাশনা সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, মো এত কলরব পছন্দ করছেন না। নতুন লেখায় হাত দিয়েছেন, তাই নিয়েই ব্যস্ত। |