শিলিগুড়ি শহরের রবীন্দ্রনগর মোড়। মাঝরাতে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে ফুটপাথের পাশে একটা দোকানের সামনে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছেন এক ব্যক্তি। তাঁকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো দু’হাত তুলে যে কোনও একটা গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছেন দুই মহিলা।
পরের পর গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাতের বেলা উটকো ঝামেলা কে আর ঘাড়ে নেয়! অন্য রকম ভেবেছিলেন সাদা পোশাকে থাকা শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর দীপঙ্কর সোম এবং তাঁর গাড়ির চালক বেদনারায়ণ থাপা (তিনিও পুলিশকর্মী)। বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে অসুস্থ ব্যক্তিকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুললেন ওই দু’জন। নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তির ব্যবস্থাও করলেন। সুস্থ হয়ে উঠলেন ব্যবসায়ী খোকনচন্দ্র সাহা।
মাঝবয়সী খোকনচন্দ্রবাবুর কাপড়ের দোকান আছে। তিনি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের রোগী। মঙ্গলবার রাত ১১টা নাগাদ আচমকা মাথা যন্ত্রণা ও পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোকজন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য নানা জায়গায় ফোন করেন। কিন্তু, বৃষ্টিতে দেরি হবে বলে সবাই জানায়। খোকনবাবু প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়ায় তাঁর স্ত্রী রমাদেবী ও বোন মাধবীদেবী তাঁকে ধরাধরি করে কোনও মতে রবীন্দ্রনগর মোড়ে নিয়ে যান।
খোকনবাবুকে দোকানের সামনে বসিয়ে দু’জনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করতে থাকেন। তাঁদের হাজার কাকুতি-মিনতি বা চিৎকারেও কোনও গাড়ি থামছিল না।
ওই সময়ে সেখান দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন দীপঙ্করবাবুরা। দুই মহিলাকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করতে দেখে তাঁরা গাড়ি থামান। সব শুনে দীপঙ্করবাবুরা খোকনবাবুকে গাড়ির সিটে শুইয়ে সোজা কলেজপাড়ার একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যান। চিকিৎসক-কর্মীদের ডেকে দ্রুত রোগীকে আইসিইউ-তে রোগীকে ভর্তি করিয়ে দেন তাঁরা। নার্সিংহোমের যে চিকিৎসক প্রথমে খোকনবাবুকে দেখেছেন, সেই সুশীল রায় এ দিন বললেন, “রোগীর রক্তচাপ অস্বাভাবিক বেশি হয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে ডায়াবেটিসও রয়েছে। আর একটু দেরি হলে আরও বড় ধরনের বিপদ হতে পারত।”
দীপঙ্করবাবুদের তৎপরতায় আপাতত বিপদ কেটেছে।
বুধবার বিকেলে খোকনবাবুকে আইসিইউ থেকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ঘটনা হল, দীপঙ্করবাবুরা সাদা পোশাকে থাকায় নার্সিংহোমের কর্মী, চিকিৎসক কিংবা রমাদেবীরা তাঁদের পুলিশকর্মী বলে চিনতেই পারেননি। তার উপরে স্পেশাল ব্রাঞ্চের গাড়িতেও সাধারণত ‘পুলিশ’ কথাটি লেখা থাকে না। ভর্তি পর্ব মিটিয়ে
ওই দু’জন যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময়ে রমাদেবী ও মাধবীদেবী ছুটে গিয়ে কত ভাড়া দিতে হবে, জানতে চান। দীপঙ্করবাবু বলেন, “মাফ করবেন। এটা আমাদের কাজের মধ্যেই পড়ে। আমরা পুলিশকর্মী।’’
গাড়িতে ওঠার আগে দুই মহিলার কাছে গিয়ে নিজেদের অফিসের ঠিকানা দিয়ে দুই পুলিশকর্মী জানিয়ে দেন, যে কোনও দরকার পড়লে তাঁদের সঙ্গে যেন যোগাযোগ করা হয়। মঙ্গলবারও দু’জনে নার্সিংহোমে গিয়ে রোগীকে দেখে আসেন।
গোটা ঘটনায় পুলিশ সম্পর্কে ‘একটা নতুন ধারণা’ তৈরি হয়েছে খোকনবাবুর বাড়ির লোক ও নার্সিমহোমের কর্মীদের মনে। খোকনবাবুর মেয়ে, দশম শ্রেণির পড়ুয়া শম্পা বলল, “এমন পুলিশও হয়! বাবাকে বাঁচানোর জন্য ওঁদের আমি প্রণাম করছি।”
দীপঙ্করবাবু কিংবা বেদনারায়ণ, দু’জনেই মনে করেন, তাঁরা নিজেদের ‘ডিউটি’ করেছেন। দীপঙ্করবাবুর মন্তব্য, “একজন মানুষের বিপদে আরেক জন দাঁড়াবেন, এটাই কি স্বাভাবিক নয়?।” শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার আনন্দ কুমারের কথায়, “ঘটনাটি দৃষ্টান্তমূলক। সবার সব সমস্যার সমাধান পুলিশ করতে পারবে না। কিন্তু, মানুষের পাশে তো দাঁড়াতে হবে! আশা করি, ওই দু’জনের মানবিকতা অন্যদেরও উৎসাহ দেবে।”
আর নার্সিংহোমের এক কর্মীর মন্তব্য, “রাখে পুলিশ, মারে কে?” |