জন্মের পরে টানা কুড়িটা বছর তিনি যেন মৃত্যু-মিছিলে হেঁটেছেন। চোখের সামনে মারা যেতে দেখেছেন সাত সাতটা ভাইবোনকে। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে এসেও মৃত্যু তার পিছু ছাড়েনি। কোলে মাথা রেখে চিরঘুমের দেশে চলে গিয়েছে নিজের তিন সন্তান। তারপরেও মৃত্যু কিন্তু তাঁকে ভয় দেখিয়ে নুইয়ে দিতে পারেনি। তিনিও কপালের দোহাই দিয়ে চুপ করে বসে থাকেননি। নবদ্বীপের বছর পঁয়ষট্টির হতদরিদ্র লক্ষ্মীরানি দেবনাথ মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এখন পথ হাঁটেন মৃত্যুর মুখ থেকে অজয়কে জয় করে ফিরিয়ে আনার জন্য।
অজয় লক্ষ্মীদেবীর আড়াই বছরের ছোট নাতি। অজয়ের অসুখ দেখে নবদ্বীপ হাসপাতালের চিকিৎসক বলেছিলেন, “নাতির রোগটা ভাল নয়।” শিউরে উঠেছিলেন তিনি। চকিতে মনের মধ্যে ভেসে উঠেছিল বেশ কয়েকটি হারিয়ে যাওয়া কচি মুখ। কোনরকমে কান্নাটা গিলে নিয়ে চিকিৎসককে বলেছিলেন, “আপনি বলুন কী করতে হবে? তাই আমি করব।”
সত্যিই ছাড়েননি। আড়াই বছরের নাতি অজয় দেবনাথের কিডনির জটিল রোগ ধরা পড়তেই যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন ঠাকুমা লক্ষ্মীরানি। চিকিৎসকদের কথা মতো নবদ্বীপ প্রতাপনগর থেকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল, কলকাতা নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ঘুরে সোজা ভেল্লোর। তারপর বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ঘুরে আবার শিশুমঙ্গল, কোথায় না গিয়েছেন তিনি!
একহাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটভর্তি কাগজপত্র, অন্যহাতে আঁকড়ে ধরা রোগে ফুলে যাওয়া নাতির অসুস্থ হাত। তিনি লক্ষ্মীদেবী আপ্রাণ ছুটে চলেছেন জীবনের জন্য। কিন্তু আপনি কেন? অজয়ের বাবা, মা- ওরা কোথায়? উত্তরে তিনি বলেন, “আমার বড় ছেলের কোন উপার্জন নেই। আগে তাঁত বুনত এখন বেকার। ও কী করে চিকিৎসা করাবে? তাই নিজেই দায়িত্বটা নিয়েছি। আমি ঘর পোড়া গরু।” |
লক্ষ্মীদেবীর লড়াইটা নতুন নয়। সেই ছেলেবেলা থেকেই লড়াইটা চলছে কখনও দারিদ্র্যের সঙ্গে, কখনও মৃত্যুর সঙ্গে। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে অভাবই ছিল নিত্যসঙ্গী। সেইসব দগদগে স্মৃতি আজও লক্ষ্মীদেবীকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। অনেক কষ্টে বাঁচাতে পেরেছিলেন নিজের মাত্র দুই সন্তানকে কামাক্ষ্যা আর গোপাল। এরপরে কখনও রঙের ডাইং, কখনও চাদরের কারখানা, আবার কখনও লোকের বাড়ি বাড়ি রান্না করে কোনরকমে দিন গুজরান করেছেন নবদ্বীপ মিস্ত্রীপাড়ার লক্ষ্মীরানি।
কিডনির অসুখে আক্রান্ত নাতির চিকিসার খরচ জুটছে কী ভাবে? লক্ষ্মীদেবী বলেন, “প্রথমবার যখন ভেল্লোর যাই তখন একচিলতে জমি, আর সামান্য কিছু সোনার গহনা বিক্রি করে তেইশ হাজার টাকা জোগাড় করেছিলাম। পাড়ার ছেলেরাও হাজার দশেক টাকা তুলে দিয়েছিল। কিন্তু মাত্র দেড় মাসের চিকিৎসাতেই সেই টাকা খরচ হয়ে গেল। নাতিকে নিয়ে ট্রেনে কার্যত ভিক্ষা করে বাড়ি ফিরেছিলাম। সেই শুরু লোকের কাছে হাত পাতা। তারপর এই তিন বছরে প্রায় তিন লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ হয়েছে নাতির চিকিসা চালাতে।”
এলাকার মানুষেরা জানাচ্ছেন, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত লক্ষ্মীদেবী ব্যস্ত থাকেন নাতির চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করতে। তারপর সংগৃহীত টাকায় ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরে অন্য কাজকর্ম করেন। কেবলমাত্র চিকিৎসার প্রয়োজনে নাতিকে নিয়ে যখন বাইরে কোথাও যেতে হয় তখনই কেবল ছেদ পড়ে এই রোজনামচায়। লক্ষ্মীদেবী জানান, “ডাক্তারবাবুরা বলেছেন অজয়কে পনেরো বছর পর্যন্ত এই চিকিৎসা করিয়ে যেতে হবে। তবেই ও অনেকদিন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাঁচতে পারবে। এখন সবে পাঁচ। আরও দশটা বছর এইভাবেই আমাকে চালাতে হবে।”
প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, শুধু অজয় নয়, লক্ষ্মীদেবীর দুই ছেলের ছয়টি সন্তানও কার্যত তাঁর কাছেই থাকে। তাদের বয়স তিন থেকে তেরো। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান লক্ষ্মীদেবী, বলেন, “ওরা সবাই কাছে থাকলে আমার ভাল লাগে। মনে হয় সেই ছেলেবেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাইবোনগুলো ফের ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে সন্তানরাও। তাই ওদের কাছছাড়া করতে চাই না।” ভরসন্ধ্যায় ঘরের ভিতরে জ্বলতে থাকা প্রদীপের সলতেটা একটু উসকে দিলেন লক্ষ্মীদেবী। |