বিলাস-বৈভব আর নেই। জমিদারি বাড়ির ঠাঁটবাটের কাহিনীও গল্পের মতো শোনায়। তবে, বাড়িতে ঢোকার মুখে ক্ষয়াটে সিংহ-দরজা, ঘরের সিলিংয়ে কড়ি-বড়গার উপস্থিতি, বাক্সবন্দি ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটির সময়কালের নথিপত্র যেন চোখের সামনে তুলে ধরে সেই আমলের খণ্ডচিত্র। এই চিত্র হুগলির হরিপালের কৈকালা স্টেশন থেকে ঢিলছোড়া দুরত্বে বিশ্বাস বাড়ির। জমিদারি আমলে শুরু হওয়া পুজো মাঝে চার দশকেরও বেশি সময় বন্ধ ছিল। গত পাঁচ বছর ধরে ফের চালু হয়েছে সেই পুজো। পরিবারের পুর্বপুরুষ পঞ্চানন বিশ্বাসের চার পুত্রের হাত ধরে বর্তমানে পুজো চলছে।
পুজোর বয়স ঠিক কত তা নির্দিষ্ট ভাবে জানা যায় না। প্রতিবেশী প্রৌঢ় শান্তিময় দে জানালেন, প্রায় শ’দেড়েক বছর আগের একটা হিসেব পাওয়া যায়। অনেকে অবশ্য বিশ্বাস করেন, এই পুজো তারও অনেক পুরনো। জমিদারি আমলে ধুমধাম করে পুজো হত। দুর্গামণ্ডপ ছিল অনেকটা উঁচু। পরে তা সংস্কার করার সময় উচ্চতা কমানো হয়। শোনা যায়, জমিদারির সময়ে ধনেখালির মাকালপুরের জমিদারের সঙ্গে বিশ্বাসবাড়ির আদান-প্রদান ছিল। পুজোর সময় দু’তরফেই উপঢৌকন আদান-প্রদান হত। মাকালপুর থেকে উপঢৌকন নিয়ে এই বাড়িতে আসত হাতি। বাড়িতে ঢুকতে হাতির যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য বেশ লম্বা-চওড়া করেই বানানো হয়েছিল সিংহদরজা। সেই দরজা এখন ভগ্নপ্রায়। পঞ্চাননবাবুর জ্যাঠামশাই সতীশবাবুর আমলে জমিদারি নিলাম হয়।
বাড়ির লোকজনের বিশ্বাস, দেবী জাগ্রত। অনেকেই আগে মানত করতেন এখানে। যদিও, এক সময় নানা কারণে পুজো বন্ধ হয়ে যায়। পঞ্চাননবাবুর ছেলে সমীর, নির্মল, অমিত এবং প্রবীর গত পাঁচ বছর ধরে ফের পুজো চালু করেছেন। জমিদারির আভিজাত্যের কার্যত কিছুই অবশিষ্ট নেই। এক ভাই সমবায় ব্যাঙ্কে কাজ করেন, দু’জন ট্রেনে হকারি করেন। স্টেশনের কাছে একটি চায়ের দোকান এবং বাড়ির সামনে একটি মুদিখানা রয়েছে। একটি পুকুরও আছে। প্রবীরবাবু জানালেন, জমিদারির অনেকটা অংশের প্রজাসত্ব বিলি হয়ে যায়। পরিবারের অন্য শরিকেরা থাকেন কিছুটা অংশে।
পুরনো আমলের জাঁকজমক না থাক, যেটুকু সম্ভব, পুরনো রীতি মেনেই বর্তমানে বিশ্বাসবাড়িতে পুজো হয়। একচালায় ডাকের সাজের প্রতিমা। অষ্টমীতে অঞ্জলী দিতে গ্রামবাসীরা এই বাড়িতে ভিড় করেন। অনেকেই ভোরে ফুল তুলে আনেন। যেমনটা হত আগেকার দিনে। তবে আগের মতো এখন আর ছাগবলি হয় না। তার বদলে সন্ধিপুজো এবং নবমীতে ছাঁচি কুমড়ো, আখ এবং অন্যান্য ফল বলি দেওয়া হয়। নবমীর দুপুরে গ্রামের মানুষকে খাওয়ানো হয়। প্রবীরবাবু বলেন, “বাড়িতে বেশ কয়েকটি নারকেল গাছ আছে। পুজোর সময় গাছের নারকেল দিয়েই নাড়ু তৈরি করা হয়।” তিনি জানান, দুর্গার কানের দুল, কপালের টিপ এবং হার সোনার। বাকি গয়না রুপোর। পুজোর দিনগুলিতে অনেক আত্মীয়ও আসেন। দশমীর রাতে বিসর্জন হয় পাশেই কৌশিকি নদীতে। বিসর্জনের শোভাযাত্রায় সামিল হন আশপাশের অনেকেই। দুর্গাদালানের পাশের মন্দিরে নারায়ণের নিত্যপুজো হয়।
পুজোর আর হাতেগোনা কয়েকটা দিন বাকি। দুর্গাদালানের সামনে বাঁশের ম্যারাপ পড়েছে। সেখানে দিনভর আনাগোনা লেগে রয়েছে ছোট-বড় সকলের। ঠাকুরদালানে তুলি হাতে মায়ের রূপসজ্জায় ব্যস্ত শিল্পী। |