প্রবন্ধ ...
আইনস্টাইন মানেননি, তবু...
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের শ্রেষ্ঠ জীবনীগ্রন্থ ‘সাটল ইজ দ্য লর্ড’ আব্রাহাম পায়াস শুরু করেছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। পায়াস অনুজ বিজ্ঞানী, গবেষণা করছিলেন আইনস্টাইনের সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে। প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভ্যান্স স্টাডিতে। প্রতিষ্ঠান থেকে দু’জনের বাসাগার হাঁটাপথ। দ্বিপ্রাহরিক আহার সারতে দু’জনেই হেঁটে আসতেন নিজ নিজ ঠিকানায়। কখনও-সখনও দু’জনে হাঁটতেন এক সঙ্গে। সে অভিজ্ঞতা অনির্বচনীয়, পায়াস জানিয়েছেন। মহাবিজ্ঞানী জীবনের সীমায়, স্বভাববশত আবেগ-উচ্ছ্বাস ঈষৎ কম। আর পায়াস তরুণ, স্বভাবগুণে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে মোহিত, রীতিমত উত্তেজিতও। দু’জনের আলাপে উঠে আসত বিবিধ প্রশ্ন, কূট-গূঢ় সমস্যাদি।
এক দিন। আইনস্টাইন এবং পায়াস হাঁটছেন পাশাপাশি। হঠাৎ থামলেন বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী। দুম করে পায়াসকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, তুমিও কি বিশ্বাস কর, যখন তাকাচ্ছি না আকাশের দিকে, তখন চাঁদটা ওখানে নেই?’ পায়াস থ! কী জবাব দেবেন জিজ্ঞাসার? তিনি তো জানেন এ প্রশ্নের মানে। তখন যে পদার্থবিজ্ঞানে ধুন্ধুমার চলেছে প্রায় পায়াসের সমবয়সি নতুন এক শাস্ত্র নিয়ে। নাম তার কোয়ান্টাম মেকানিক্স, প্রতিপাদ্য তার নেহাতই অবিশ্বাস্য। যেমন? শনাক্ত হওয়ার আগে কোনও বস্তুর অস্তিত্ব প্রায় নেই, আর যদি থাকেও বা, তা হলে সে অস্তিত্ব বড় আবছায়া, একই বস্তু একই মুহূর্তে রয়েছে এক জায়গার বদলে বহু জায়গায়। দেখা মানে শনাক্ত করা। আর শনাক্ত করার কাজটাই বস্তুটিকে এক সঙ্গে অনেকগুলো জায়গার বদলে দাঁড় করায় একটা নির্দিষ্ট জায়গায়।
এ হেন তত্ত্ব মানলে চাঁদকে নিয়ে যে বড় গেরো! যখন কেউ চোখ মেলছে না আকাশে, তখন তা হলে চাঁদের অস্তিত্বই নেই। চাঁদ তো ‘তৈরি’ হবে তখন, যখন কেউ তার দিকে তাকাবে। ধুত, এমন দাবি মানা যায় নাকি? হোক না নব্য বিজ্ঞান, তার ধ্বজাধারী হোক না তরুণ গবেষকেরা, আইনস্টাইন অমন দাবি মানেন কী করে? নব্য চিন্তার সোৎসাহী সমর্থক পায়াসকে তাই প্রশ্নটা না করে পারেননি তিনি। আর পায়াস? জীবনীর শুরুতে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, আমৃত্যু কোয়ান্টাম-বিরোধিতায় কতখানি অনড় ছিলেন আইনস্টাইন।
হায়, আইনস্টাইনের আপত্তিতে খারিজ হয়নি কোয়ান্টাম। বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে তার মহিমা। কারণ, পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে তা নিখুঁত, নির্ভুল। কতখানি সঠিক? পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব মাপতে কয়েক চুল এ দিক-ও দিক হলে সেটাকে যতখানি নিখুঁত বলা যায়, ঠিক ততখানিই নির্ভুল কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
প্রসঙ্গটা এসে পড়ল মঙ্গলবার স্টকহলম থেকে প্রচারিত খবরে। পদার্থবিদ্যায় এ বার নোবেল প্রাইজ পেলেন ফ্রান্সের সার্গে আরশ এবং আমেরিকার ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড। কোয়ান্টামের প্রতিপাদ্যগুলি অবিশ্বাস্য শোনালেও, সে সব যে ঠিক, তা পরীক্ষায় প্রমাণ করেছেন ওঁরা। দু’জনের পরীক্ষা আলাদা। দু’টিই বেশ জটিল। খবরের কাগজের প্রবন্ধে পরীক্ষাগুলির বর্ণনা গভীরে দেওয়া যায় কি না, তা-ও সন্দেহের বিষয়। বর্ণনা এ ক্ষেত্রে তেমন প্রয়োজনীয়ও নয়। যা বলার, তা এই যে, কোয়ান্টাম গবেষণায় ঘটেছে রীতিমত পর্বান্তর। এখন যেন অন্য যুগ।
কোয়ান্টামের সূত্রপাত ১৯০০ সালে, যখন ম্যাক্স প্লাংক বললেন যে, এনারজি অখণ্ড কোনও জিনিস নয়, তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টুকরো আছে। প্রসঙ্গত, কোয়ান্টামের জনকদের মধ্যে আইনস্টাইনও রয়েছেন। যে গবেষণার জন্য ১৯২২-এ নোবেল প্রাইজ পান তিনি, তা তো ওই এনারজি’র টুকরো সম্পর্কিত ধারণার জন্যই (তিনিই কি-না পরে এর বিরোধী!)। তার পর কোয়ান্টাম নিয়ে তত্ত্ব এবং দাবি পেশ করলেন অনেকে। নিলস বোর, ভার্নার হাইজেনবার্গ, হোল্ফগাং পউলি ইত্যাদি। পদার্থবিদ্যা গবেষণায় গত শতাব্দীর অনেকখানি জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন ওঁরা, ওঁদের মতামতগুলি যেন শিরোধার্য, পাথরে খোদাই করা ঈশ্বরের অনুজ্ঞার সামিল।
অথচ আশ্চর্য, ওঁদের মতামতগুলি অনেকটাই যেন দার্শনিক, বিশেষজ্ঞদের তকমায় ‘মেটাফিজিক্স’। কাঁচা বাংলায় ‘ভাবালুতায় ভরা’। কেন এমন অভিযোগ? ব্যাখা করা যাক উদাহরণ সহযোগে। টেনে আনা যাক দু’জনের কথা, যাঁরা মানতে চাইছিলেন না কোয়ান্টামের নানা অদ্ভুতুড়ে দাবি।
প্রথম জন অবশ্যই আইনস্টাইন। কোয়ান্টাম যে বাস্তবের আসল রূপ নয়, তা প্রমাণের দুই সহকারি বরিস পোডলস্কি এবং নাথান রোজেন-এর সঙ্গে একখানি পেপার লিখলেন তিনি। শিরোনাম ‘ক্যান কোয়ান্টাম মেকানিকাল ডেসক্রিপশন অব ফিজিকাল রিয়ালিটি বি কনসিডার্ড কমপ্লিট?’ ১৯৩৫ সালে ‘ফিজিকাল রিভিয়ু’ জার্নালে প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে তিন বিজ্ঞানী তুলে ধরলেন এক ‘গেডাংকেন’ (কাল্পনিক) এক্সপেরিমেন্ট। কী সেই পরীক্ষা, যা লেখা হল শুধু কোয়ান্টামের খুঁত ধরতে? বিজ্ঞানীরা বললেন, ধরা যাক দু’টো কণা। ‘ক’ এবং ‘খ’। ওরা বিক্রিয়া করল নিজেদের মধ্যে। তার পর প্রবল বেগে ‘ক’ চলে গেল পুবে। ‘খ’ পশ্চিমে। ছুটতে ছুটতে এক জন ব্রহ্মাণ্ডের এ প্রান্তে, তো অন্য জন ও প্রান্তে। বিজ্ঞানের নিয়মে ‘ক’ এবং ‘খ’ গাঁটছড়ায় আবদ্ধ। মানে, কোনও একটা ধর্ম ‘ক’-এর যা হবে, ‘খ’-এর হবে ঠিক উল্টো।
এখন যদি পরখ করা হয়, ‘ক’ এবং ‘খ’-এর নানা ধর্ম, তা হলে কী হবে? কোয়ান্টাম শাস্ত্র বলছে, পরখ করার আগে ‘ক’-এর ধর্ম বলে কিছু নেই, ধর্ম তৈরি হবে পরখ করার মুহূর্তে। ধরা যাক, পরখ করা হল ‘ক’ এর কোনও এক ধর্ম, পরীক্ষায় ধরাও পড়ল তা। যেই পড়ল ধরা, সেই মুহূর্তে ব্রহ্মাণ্ডের অন্য প্রান্তে বসে-থাকা ‘খ’-ও ধর্ম পেল একটা। যা অবশ্যই ‘ক’-এর ধরা-পড়া ধর্মের উল্টো। এতো ম্যাজিক! ‘ক’-কে নিয়ে পরীক্ষার আগে ‘খ’-এর ওই ধর্ম ছিলই না? না-ও থাকে যদি, তা হলে এখন পরীক্ষার মুহূর্তে ‘ক’ ‘খ’-কে জানিয়ে দিল, আমার ধর্ম শনাক্ত হয়েছে, এ বার তোমার ধর্ম তৈরি করে ফেল। এই সংকেত ‘ক’ ‘খ’-কে পাঠাল কী ভাবে? ব্রহ্মাণ্ডের এ প্রান্ত-ও প্রান্ত মানে তো কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের ব্যাপার। মুহূর্তের মধ্যে সংকেত এত দূর পাড়ি দিল কী ভাবে? আলোর চেয়ে অ-নে-ক, বেশি বেগে? কিন্তু আলোর চেয়ে বেশি স্পিড তো অসম্ভব। সুতরাং আইনস্টাইন ও তাঁর দুই সতীর্থ বললেন, কোয়ান্টামের বক্তব্য বাস্তবের আসল রূপ হতে পারে না।
আর এক জন বিজ্ঞানী। নাম তাঁর আরউইন শ্রোয়েডিংগার। যথার্থ প্লেবয়। স্ত্রী ছাড়াও প্রেমিকা অনেক। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল প্রাইজ নিতে যখন স্টকহলম-এ, তখনও স্ত্রীর পাশে হাজির ছিলেন এক প্রেমিকা! কোয়ান্টামের বিখ্যাত এক ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিলেন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে। আলপস-এ স্কি রিসর্ট-এ গোপন প্রেমিকার সান্নিধ্যে বসে। এ হেন শ্রোয়েডিংগারও কোয়ান্টামের খুঁত ধরতে চেয়ে বলেছিলেন আর এক কাল্পনিক পরীক্ষার কথা। বিখ্যাত জার্মান জার্নাল ‘নাচুরউইজেনস্কাফতেন’ ছেপেছিল তাঁর সেই পরীক্ষামূলক প্রবন্ধ।
কাল্পনিক সেই পরীক্ষাটি অমর হয়ে আছে পদার্থবিজ্ঞানে। পরীক্ষার নায়ক (না কি নায়িকা?) এক বিড়াল। যে বন্দি ডালাবন্ধ বাক্সে। পশুপ্রেমীরা মাফ করবেন, স্বয়ং শ্রোয়েডিংগার কবুল করেছিলেন, পরীক্ষাটি কিম্ভুত। কেমন? বেড়ালের সামনে বাক্সে রয়েছে পটাশিয়াম সায়ানাইড ভর্তি শিশি, একটি হাতুড়ি আর একটি পাত্রে সামান্য তেজস্ক্রিয় পদার্থ। পদার্থের কণা তেজস্ক্রিয়তা দেখালেই হাতুড়িতে পড়বে ঘা, ভাঙবে শিশি, ছড়াবে পটাশিয়াম সায়ানাইড, মরবে বিড়াল। এখন, তেজস্ক্রিয়তা দেখানো কোয়ান্টামের ব্যাপার। অর্থাৎ সম্ভাবনার জিনিস। ঘটেছে কী ঘটেনি, নিশ্চিত বলা যায় না। বলা যায় শুধু ঘটার সম্ভাবনা কতটা। এ অবস্থায় বিড়াল বাক্সে বন্দি রইল এক ঘণ্টা। এই সময়টায় বিড়ালের কী দশা? আমরা বলব, তেজস্ক্রিয়তা ঘটেছে বা ঘটেনি, হাতুড়িতে ঘা পড়েছে বা পড়েনি, বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়েছে বা ছড়ায়নি, বিড়াল মরেছে বা মরেনি। ধুত, শ্রোয়েডিংগার বললেন, কোয়ান্টাম শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য তো এমন সরল নয়। কোয়ান্টাম অনুযায়ী, তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছে ও ছড়ায়নি, হাতুড়িতে ঘা পড়েছে ও পড়েনি, গ্যাস ছড়িয়েছে ও ছড়ায়নি, বিড়াল মরেছে ও মরেনি। অর্থাৎ বন্ধ বাক্সে একই বিড়াল রয়েছে জীবিত ও মৃত অবস্থায়। শ্রোয়েডিংগার এ ভাবেই তুলে ধরলেন কোয়ান্টাম শাস্ত্রের ত্রুটি।
যে দুই বিখ্যাত পেপারের কথা বললাম, তাদের উপজীব্য থট এক্সপেরিমেন্ট। কোয়ান্টাম নিয়ে তর্কাতর্কিতে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কাল্পনিকতার বিস্তার বেশ দৃঢ়। কোয়ান্টাম তখন মেটাফিজিক্স।
সেই যুগ এখন অন্তর্হিত। ১৯৭০-এর দশক থেকে কোয়ান্টাম গবেষণায় নতুন পর্ব। নতুন যুগের বিজ্ঞানীরা তর্কাতর্কির কূটকাচালি থেকে কোয়ান্টামকে টেনে এনেছেন পরীক্ষানিরীক্ষার শক্ত ঠাঁইতে। এই গবেষকদের গুরু জন বেল, অ্যালান অ্যাস্পেক্ট, ডেভিড ডয়েস, অ্যান্টনি লেগেট, অ্যন্টন জাইলিংগার, নিকোলাস গিসিন প্রমুখ বিজ্ঞানীরা। এ বার যাঁরা নোবেল পুরস্কার পেলেন, সেই আরশ কিংবা ওয়াইনল্যান্ড-ও ওঁদেরই দলে। সবই মিলে কোয়ান্টাম চর্চাকে বদলে দিচ্ছেন ওঁরা। কোয়ান্টাম শাস্ত্রেরও ঘটছে নামবদল। ‘মেটাফিজিক্স’ থেকে তা এখন ‘এক্সপেরিমেন্টাল মেটাফিজিক্স’। নব্য বিজ্ঞানীদের উদ্যোগে মনে পড়ছে কার্ল মার্ক্সের সেই বিখ্যাত উপলব্ধি: দর্শনের কচকচি তো অনেক হল, এ বার কিছু কাজ করে দেখা যাক।
সত্যি, কোয়ান্টামের অদ্ভুতুড়ে প্রতিপাদ্যগুলিকে সত্য প্রমাণ করে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির কত নতুন দরজা খুলছেন ওঁরা, বলে শেষ করা যায় না। অকল্পনীয় ক্ষমতাবান কম্পিউটার, কিছুতেই আড়ি পাতা সম্ভব হবে না এমন গোপন খবর আদানপ্রদান বা কখনও হ্যাক করা যাবে না এমন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে এখন ব্যস্ত এক্সপেরিমেন্টাল মেটাফিজিসিস্টরা। নতুন প্রযুক্তির অত্যাধুনিক নমুনাগুলি পেশ করলাম। এমন সাফল্যের লক্ষ্যে ছুটছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
মস্তিকের ব্যায়াম থেকে বাস্তবের রুক্ষ মল্লযুদ্ধে। এই তো বিজ্ঞান।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.