পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে মেডিক্যাল কলেজ করতে চাইছে। এমন প্রস্তাবে আপনারা কি আগ্রহী হবেন?
আমি মনে করি, মেডিক্যাল কলেজ হওয়া উচিত সরকারি। বিশ্বের সব দেশে অসামান্য ভাল ডাক্তাররা কিন্তু উঠে এসেছেন গরিব কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তাদেরই রয়েছে জীবনে কিছু করে দেখানোর সেই অদম্য জেদ, যার জন্য তারা দিনে ১৬-১৮ ঘন্টা সার্জারি করার মতো পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন। সম্পন্ন পরিবারের কাছে ডাক্তারি অত আকর্ষণীয় নয়, তাঁরা বরং পয়সা দিয়ে দশ-বারো জন ডাক্তারের সময় কিনে নেবেন। কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের যদি ডাক্তারি পড়তে হয়, তা হলে ডাক্তারি পড়ার খরচ কম রাখতে হবে। প্রাইভেট কলেজ করলে তা তো সম্ভব নয়।
আবার বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকালেও ‘পিপিপি’ মডেল কাজ করার সম্ভাবনা সামান্যই। বিহার, উত্তর প্রদেশ-সহ উত্তর ভারতের নানা রাজ্যে ওই মডেলে মেডিক্যাল কলেজ করার চেষ্টা হয়েছিল, সফল হয়নি। তার কারণ একটা মেডিক্যাল কলেজ শুরু করার খরচ অন্তত ২০০ কোটি টাকা, চালাতে বছরে খরচ অন্তত ৪০ কোটি। ভারত সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে কোনও কোম্পানি মেডিক্যাল কলেজ চালাতে পারে না, পারে কেবল ন্যাস (ট্রাস্ট)। অর্থাৎ একটা মস্ত অঙ্কের টাকার দীর্ঘ দিন বিনিয়োগ করতে হবে লাভের আশা ছাড়াই। কত জনের কাছে এটা প্রত্যাশা করা চলে? আমরা নিজেদের ধোঁকা দিচ্ছি।
কিন্তু আমাদের দেশে তো আরও অনেক ডাক্তার প্রয়োজন। তার জন্য আরও মেডিক্যাল কলেজও প্রয়োজন। সরকার একা কী করে এই বিপুল খরচ বহন করবে?
আমাদের দেশে সাত থেকে ১০ লক্ষ ডাক্তারের ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে আমাদের এখনই আরও ৩৭ হাজার আসন দরকার। মনে রাখতে হবে, আমরা যখন পড়াশোনা করেছি তখন ১০০ জন ডাক্তারি পাশ করলে ১০০ জনই ডাক্তারি প্র্যাকটিস করত। এখন ৩০-৪০ শতাংশই প্র্যাকটিস করে না, প্রশাসনিক কাজ বা অন্যান্য কাজ বেছে নেয়। ডাক্তারি ছাত্রদের একটা বড় অংশ মেয়ে, তারা সার্জারি এড়িয়ে যেতে চায়। তাই দেশে যত ডাক্তার দরকার তার চেয়ে কিছু বেশি ছাত্রকেই ডাক্তারি পড়াতে হবে।
|
কিন্তু প্রাইভেট কলেজ তৈরি করা তার উপায় নয়। এক দিকে এটা সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থী, কারণ গরিব, মেধাবী ছাত্ররা এ সব কলেজে সুযোগ পাবে না। নতুন কলেজ তৈরি করতে যে ২০০ কোটি টাকা ঢালবে, তাকে কলেজের আসন বিক্রির জন্য রাখতেই হবে। মোটা ক্যাপিটেশন ফি-এর বিনিময়ে মেডিক্যাল ডিগ্রি বিক্রি করতে হবে। অন্য দিকে ব্যবসার ‘মডেল’ হিসেবেও এটা কার্যকর নয়, কারণ জোগান বাড়লেই চাহিদা দ্রুত কমে যাবে। কর্নাটকে সাত-আট বছর আগেও প্রচুর নার্সিং কলেজ ছিল, সাত-আট লক্ষ টাকা ক্যাপিটেশন ফি নিয়ে তারা পড়াত। এখন কেউ ক্যাপিটেশন ফি আদায় করতে পারছে না, অর্ধেক কলেজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারণ বেশ কিছু নার্সিং কলেজ তৈরি হয়ে গিয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের ক্ষেত্রেও তাই হবে। ভারতে যদি আর ৫০টা মেডিক্যাল কলেজ খুলে যায়, বহু প্রাইভেট কলেজ দরজা বন্ধ করতে বাধ্য হবে। যে ক’টি প্রাইভেট কলেজ ভাল কাজ করছে, যেমন ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ ভেলোর বা সেন্ট জনস মেডিক্যাল কলেজ, বেঙ্গালুরু, তারা কিন্তু ছাত্রদের থেকে অল্পই ফি নেয়। হাসপাতালের লাভ থেকে তারা মেডিক্যাল কলেজ চালায়। অধিকাংশ প্রাইভেট কলেজ ছাত্রদের ফি-এর টাকায় হাসপাতাল চালায়। এ মডেল চলতে পারে না।
মেডিক্যাল কলেজ তৈরির উপায় তবে কী?
কলেজ খুলতে হবে সরকারকেই, আর তা করতে গেলে কলেজ তৈরির খরচ কমাতে হবে। আর সে জন্য বদলাতে হবে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার শর্ত। একটা মেডিক্যাল কলেজের জন্য দরকার তিন-চারশো বেডের একটা বড় হাসপাতাল, এবং পঠন-পাঠনের উপযুক্ত পরিকাঠামো। কেন ২৫ একর জমি দরকার? নিজস্ব খেলার মাঠ, শিক্ষক-কর্মীদের জন্য কলেজের নিজস্ব আবাসন, ছাত্রদের জন্য ক্যাম্পাসের মধ্যে হস্টেল, সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড অডিটোরিয়াম, এগুলো সত্যিই প্রয়োজন কি? অন্য কোনও দেশে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির জন্য এমন কঠিন সব শর্ত তৈরি করা হয়নি। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনা করেছি যেখানে, সেই গাইজ হসপিটাল মেডিক্যাল স্কুল মাত্র তিন একর জমিতে তৈরি। ভাল ডাক্তার চাইলে দেখতে হবে, ছাত্ররা রোগীদের সুরক্ষিত রেখে চিকিৎসা করতে পারছে কি না। প্রশিক্ষণের পরিবেশকে খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তার মধ্যেই গলদ রয়েছে। আমার মনে হয়, অনাবশ্যক শর্ত বাদ দিলে ২০-৩০ কোটি টাকাতে একটা মেডিক্যাল কলেজ শুরু করা যেতে পারে।
আর তা করতে হবে প্রতিটি জেলাতে। জেলা হাসপাতালগুলির সঙ্গে এক একটা মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করা দরকার। ডাক্তাররা যেখানেই প্রশিক্ষণ নিন, প্র্যাকটিস করতে চান নিজের রাজ্যে, নিজের এলাকায়। ঝাড়খণ্ডের জেলার একটি ছেলে আই টি পড়লে বেঙ্গালুরু গিয়ে কাজ করবে, কিন্তু ডাক্তারি পড়লে তার নিজের জেলায় কাজ করার সম্ভাবনা বেশি। তাই জেলায় ডাক্তার চাইলে জেলাতে মেডিক্যাল কলেজ খুলতে হবে। অবশ্যই সকলে বড় শহরগুলোতে কাজ করতে চান। কিন্তু বেঙ্গালুরু বা কলকাতা কতই বা ডাক্তারকে কাজ দিতে পারে? বাকিদের কাজ খুঁজে নেবেন জেলা শহরে, গ্রামে। তাই যেখানে ডাক্তার প্রয়োজন, সেখানে তৈরি করতে হবে মেডিক্যাল কলেজ।
প্রতি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ শুরু করার টাকা যদি বা পাওয়া যায়, অত শিক্ষক কী করে পাওয়া যাবে?
প্রতি জেলাতেই এমন ডাক্তাররা রয়েছেন যাঁরা সার্জারি করছেন, চিকিৎসা করছেন। তাঁরাই পড়াবেন ছাত্রদের। মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া পুরো সময়ের শিক্ষক নিয়োগের শর্ত তৈরি করে একটা কৃত্রিম অভাব তৈরি করে রেখেছে। ভারতে একটা ১০০-আসনের কলেজ খুলতে ১৪০-১৫০ শিক্ষক প্রয়োজন। ব্রিটেনের জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল কিন্তু বলছে, ১০০-আসনের কলেজের জন্য কেবল ৪০ জন পুরো সময়ের শিক্ষক প্রয়োজন। যাঁরা প্র্যাকটিস করে নিজের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরাই আংশিক সময়ের জন্য মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদের পড়ান, হাতে-কলমে কাজ দেখান। ব্রিটেনে এক জন ৮৫ বছর বয়সের শিক্ষক রোগীর উপর সার্জারি করে দেখাতে পারেন ছাত্রদের। ভারতে ৬৫ বছর পেরোলে অ্যানাটমির শিক্ষক আর একটি মৃতদেহ কেটে দেখানোরও যোগ্য বিবেচিত হন না। এক দিকে ১৫০ জন শিক্ষক যথেষ্ট ক্লাসের অভাবে বসে থাকেন, অন্য দিকে শিক্ষকের অভাবে নতুন কলেজ খোলা যায় না। সবই রয়েছে, কিন্তু কোনওটাই মানুষের কাজে লাগানো যাবে না এমনই ব্যবস্থা আমাদের।
চিকিৎসকের অভাব থাকলে লাভ ডাক্তারদেরই বেশি। ডাক্তাররাই মেডিক্যাল কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে কলেজ তৈরির শর্ত কঠোর করছেন। আবার স্বল্পমেয়াদি ডাক্তারি কোর্স কিংবা ‘নার্স প্র্যাকটিশনার’ তৈরির প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন। এই অবস্থা বদলাবে কী করে?
সাধারণ মানুষকেই চাপ সৃষ্টি করতে হবে সরকারের উপর, যাতে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ে। তাঁরা তো দেখতেই পাচ্ছেন, শিশু মৃত্যু, মায়ের মৃত্যু হলে হাসপাতালে ভেন্টিলেটর বসে যাচ্ছে, পুরো ওয়ার্ড এয়ারকন্ডিশনড হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু শিশু চিকিৎসক, স্ত্রীরোগ চিকিৎসক বা অজ্ঞান করার ডাক্তার নিয়োগ করা যাচ্ছে না। মেডিক্যাল পড়াশোনার শর্ত না বদলালে যে চিকিৎসার সংকট কাটবে না, বরং আরও বড় সংকটের দিকে আমরা এগিয়ে যাব, তা মানুষকে বোঝানোর মতো নেতা আজ আমাদের প্রয়োজন। |