পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সোয়াট উপত্যকায় মালালা ইউসুফজাই নাম্নী ১৪ বছরের স্কুল-পড়ুয়া বালিকাকে তেহরিক-ই-তালিবানের গুণ্ডারা মাথায় ও ঘাড়ে গুলি করিয়া হত্যার চেষ্টা করিয়াছে। তাহার অপরাধ, সে নিজে স্কুলে পড়ে এবং অন্য বালিকাদেরও স্কুলের শিক্ষায় টানিয়া লইতে চায়। এই মর্মে ১১ বছর বয়স হইতেই এই সাহসিনী তালিবান রক্তচক্ষু উপেক্ষা করিয়া সচেষ্ট থাকিয়াছে। আপাতত পাকিস্তান সরকার গুলিবিদ্ধ বালিকাটিকে পেশোয়ারের সামরিক হাসপাতালে আনিয়া প্রাণপণ চিকিৎসায় তাহার প্রাণরক্ষার চেষ্টা করিতেছে। মালালা কিংবা তাহার সঙ্গেই গুলিবিদ্ধ আরও দুই সহপাঠী শেষ পর্যন্ত বাঁচিবে কিনা, অনিশ্চিত। কিন্তু এই ঘটনা তালিবানের বিপদের ভয়াবহতাকে আর এক বার তুলিয়া ধরিল।
তালিবান কী চাহে, তাহা পরিষ্কার। সমগ্র মুসলিম সমাজকে পশ্চাৎপর রাখিয়া নিজেদের মূঢ় অপকাণ্ডগুলি সম্পর্কে প্রশ্নহীন অনুমোদনের শংসাপত্র আদায় করিতে চাহে। নারীসমাজকে সম্পূর্ণ নিরক্ষর এবং নিয়ন্ত্রিত রাখিয়া সমাজ হইতে সমাজের অর্ধাংশের অধিকার ও অস্তিত্ব মুছিয়া ফেলিয়া সর্বাত্মক পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে চাহে। এই অর্থে তালিবান কেবল নারীর শত্রু নহে, মানবতার শত্রু। বারংবার এই সত্য সামনে উঠিয়া আসিয়াছে, বারংবার বহিঃপৃথিবী নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তালিবানের পুনর্ব্যাখ্যা করিতে চাহিয়াছে, ‘ভাল তালিবান মন্দ তালিবান’ বিভেদ রচিয়া সমস্যার সমাধানকল্পে আগাইয়াছে, বারংবার শিক্ষার বিস্তার, কর্মের সুযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে তালিবানের সহিত সামাজিক সংযোগ তৈরি করিয়া তাহাদের মূলস্রোতে টানিয়া আনিবার আশা করিয়াছে। কোনও ফল হয় নাই। মানবতাবোধের আলোক জ্বলিবার কোনও লক্ষণ দেখা যায় নাই। আফগানিস্তান দেশটিকে এক প্রকার জেলখানায় পরিণত করার পর পাকিস্তানকেও একই ভাবে ধর্মান্ধ পুরুষতন্ত্রের যথেচ্ছাচারে নিমজ্জিত করিতে উদ্যত তালিবান।
এই বিভীষিকাময় চ্যালেঞ্জের সামনে পাকিস্তান রাষ্ট্র কী করিবে, তাহাই প্রধান প্রশ্ন। কায়েদ-এ-আজমের ধর্মনিরপেক্ষ পাকিস্তান বহু কাল যাবৎ মৌলবাদের সহিত আপস করিয়া আসিয়াছে। ক্রমে এই আপস আফগান মুজাহিদিনের তাগিদের সহিত দেওবন্দি মাদ্রাসার তালিবানি কুসংস্কারাচ্ছন্নতার তাগিদকে মিশাইয়া দিয়াছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক শাসক গোষ্ঠী এবং সামরিক আমলাতন্ত্র সেই আপসকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়া তালিবানি জেহাদকে ঘরে-বাহিরে বৈধতা প্রদান করিয়াছে। আজ সেই বিষবৃক্ষের ফল ফলিতেছে। ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসাবে পাকিস্তানের প্রশাসনিক নৈরাজ্য ও সামাজিক অরাজকতার সুযোগ লইয়া এবং সামরিক গোয়েন্দা চক্র আইএসআইয়ের পূর্ণ প্রশ্রয়ে তালিবানি জেহাদ এখন পাক রাজনীতির মূল ধারার দখল লইতে ব্যস্ত। তালিবানরা যে ভাবে হক্কানি গোষ্ঠী, লস্কর-এ-তইবা কিংবা জামাত-উদ-দাওয়ার সহিত মিলিয়া বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করিতেছে, তাহাতে দ্রুত নির্ণায়ক অভিযানে এই জেহাদি শক্তিকে নিশ্চিহ্ন না করিলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানও তালিবানিস্তানে পরিণত হইবে। মালালা ইউসুফজাইয়ের চিকিৎসার সুব্যবস্থা নিশ্চয়ই হইতেছে, কিন্তু তাহার উপর প্রাণঘাতী হামলা ঘটিবার সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় থাকা সত্ত্বেও পূর্বেই কেন মালালা ও তাহার মতো কন্যাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা লওয়া হয় নাই, ইহাই প্রশ্ন। ইহার মধ্যেই সরকারি অসতর্কতা ও উদাসীনতার ছায়া আছে। তালিবানি জেহাদের মোকাবিলা করিতে হইলে পাক সরকারকে এই সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নটি হইতেই শুরু করিতে হইবে। |