ছিনতাইবাজদের কবলে পড়েছেন, বুঝেছিলেন বিলক্ষণ। কিন্তু চালচলন যেন ছিনতাইকারীদের মতো নয়! বরং অনেকটাই পুলিশের মতো।
ছিনতাইকারীদের এ-হেন হাবভাবে খটকা লেগেছিল চেন্নাইয়ের ব্যবসায়ী শাহুল হামিদের। ৩০ সেপ্টেম্বর অরবিন্দ সেতুতে ৪৩ লক্ষ টাকা খুইয়ে মানিকতলা থানার পুলিশকে সেই খটকার কথা জানিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। কিন্তু সত্যিই যে মানিকতলা থানার এক অফিসার ও এক কনস্টেবলই ওই ছিনতাইয়ের সঙ্গে যুক্ত, স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি।
ভরদুপুরে জনবহুল এলাকায় বিপুল পরিমাণ টাকা কেড়ে নেওয়ার ‘সাহস’ দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরাও। ছিনতাইকারীরা যে আর-পাঁচটা অপরাধীর মতো নয়, বুঝেছিলেন তাঁরা। হামিদ তাঁদের জানান, ছিনতাইয়ের সময় অরবিন্দ সেতুতে পড়ে গিয়েছিল ৫০০ এবং ২০ টাকার নোটের দু’টি করে বান্ডিল। তাড়াহুড়ো না-করে ধীরেসুস্থে তা কুড়িয়ে নিয়েছিল ছিনতাইকারীরা। বেলা ১২টায় অরবিন্দ সেতুতে ছিনতাইকারীদের এই আচরণ স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি তদন্তকারীদের। |
অর্থাৎ খটকা প্রথমে লেগেছিল হামিদেরই। তাঁর জবানি শুনে খটকা লাগে তদন্তকারীদেরও। এবং সেই খটকা থেকেই ছিনতাইকারীদের ছবি আঁকানোর কথা মাথায় আসে পুলিশের। অভিযোগকারী ব্যবসায়ীর সঙ্গী নিরঞ্জনের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে তিন জন ছিনতাইকারীর ছবি আঁকিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের তদন্তকারীরা। তিনটির মধ্যে দু’টি ছবি দুই অভিযুক্তের সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে গিয়েছে। ওই ছবির সূত্র ধরেই প্রথমে উত্তর ২৪ পরগনা থেকে এক অভিযুক্ত ছিনতাইকারীকে ধরা হয়। তার পরে গ্রেফতার করা হয় আরও তিন জনকে। জেরার মুখে ধৃতেরা জানায়, দু’জন পুলিশ তাদের সাহায্য করেছিল। কিন্তু কোন থানার পুলিশ, তা তারা জানত না।
গোয়েন্দারা তখন অরবিন্দ সেতুর কাছাকাছি তিনটি থানা বড়তলা, আমহার্স্ট স্ট্রিট ও মানিকতলার পুলিশকর্মীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার রাতে ধরা পড়েন মানিকতলা থানার এক এসআই এবং এক কনস্টেবল। কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (ইএসডি) সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার বলেন, “ধৃত পুলিশ অফিসারের নাম সুনীলকুমার দাস এবং কনস্টেবলের নাম সৌমেনকুমার ঝা। ধৃতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীদের ধারণা হয়েছিল, বরখাস্ত বা সাসপেন্ড হওয়া কোনও কনস্টেবল, অথবা কর্মরত এবং ওই এলাকার অন্ধিসন্ধি জানা এক বা একাধিক কনস্টেবল ওই ছিনতাইয়ে যুক্ত। কিন্তু মানিকতলা থানার ‘অ্যান্টি রাউডি অফিসার’ বা ‘ক্রাইম অফিসার’ নিজেই নিজের এলাকায় গাড়ি থামিয়ে টাকা লুঠে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এতটা ভাবতে পারেননি তদন্তকারীরা।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ধরা পড়ে গিয়েছেন বুঝতে পেরে সুনীল দোষ স্বীকার করে নেন। আক্ষরিক অর্থেই তিনি তখন ভয়ে কাঁপছিলেন বলে গোয়েন্দারা জানান। এক অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে মাসে ৩৫ হাজার টাকার বেশি বেতন পাওয়া সুনীল জানান, লোভে পড়ে তিনি ওই কাজ করেছেন। ডানলপের কাছে পুলিশ আবাসনে সুনীলের সঙ্গে থাকেন তাঁর দুই ছেলেমেয়ে এবং ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রী। সুনীলের দীর্ঘদিনের শাগরেদ সৌমেনের বাড়ি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে। দু’জনে আগে একসঙ্গে জোড়াবাগান থানায় কাজ করেছেন। সুনীলের বিরুদ্ধে আগেও অনেক অভিযোগ উঠেছে। জানুয়ারিতে নীলরতন সরকার হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে সুনীলকে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তার পরেও কেন তাঁকে ১০ মাস মানিকতলায় থানায় রাখা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, বখরা হিসেবে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা দুই পুলিশকর্মীর। চেন্নাইয়ের ব্যবসায়ী হামিদকে যারা ২৭৫ টাকা কিলোগ্রাম দরে ১৫ টন পুরনো পিতল বিক্রি করার টোপ দেখিয়েছিল, তারাই দুই পুলিশকর্মীকে ছিনতাইয়ের কাজে লাগায়। তাঁদের বলা হয়, পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই ব্যবসায়ীর গাড়ি থামিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে হবে। পুলিশ জানায়, ওই চক্রের ধৃত অন্য চার জন হল সুরেশ ভৌমিক, স্বপন মাইতি, মহম্মদ আমিন ওরফে পঙ্কজ ও শাহজাহান গাজি। ধৃতদের জেরা করে এই চক্রে জড়িত আরও কয়েক জনের খোঁজ মিলতে পারে বলে পুলিশের আশা। এ দিন ধৃতদের শিয়ালদহ আদালতে তোলা হয়। বিচারক ২২ অক্টোবর পর্যন্ত তাঁদের পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। বুধবার রাতে এই মামলায় অরূপ সিংহ নামে দমদম থানার এক কনস্টেবল এবং পঙ্কজ দাস নামে অন্য এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। |