গ্রামে রয়েছে দেবী চামুণ্ডার কষ্টি পাথরের মূর্তি। তাই, অন্য কোনও দেবীর মূর্তি রাখা হয় না গ্রামে। তাই মন্তেশ্বরে দুই পরিবারে দুর্গাপুজোর রেওয়াজ থাকলেও প্রতিমা আসে না বাড়িতে। পুজো করা হয় নবপত্রিকা। ওই দুই পরিবারের সদস্যদের দাবি, দেবী চামুণ্ডা রুষ্ট হতে পারেন, এই ভয়েই মাটির দেবী মূর্তি পুজো করা হয় না।
মন্তেশ্বর গ্রামের মাইচপাড়ার চৌধুরী পরিবারে নবপত্রিকা পুজো প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। ষষ্ঠীর সকালে অধিবাস ও সন্ধ্যায় ষষ্ঠীকল্পের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় পুজো। পরিবারের সদস্যেরা জানান, সপ্তমীর সকালে পরিবারের বড়পুকুরে স্নান করানো হয় নবপত্রিকাকে। সেখান থেকে আনা হয় মঙ্গলঘট। |
পরিবারের সদস্য অভিষেক চৌধুরীর কথায়, “গ্রামের দেবী চামুণ্ডার রোষের মুখে পড়তে হতে পারে ভেবে দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তির পুজো হয় না পরিবারে। এ ছাড়া আমরা সব আচারই নিষ্ঠা ভরে মেনে চলি। পরিবারের পুজো হলেও গ্রামবাসীরা স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে যোগ দেন এই পুজোয়। সপ্তমীর দিন দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে প্রদীপ জ্বালানো হয়। বিসর্জনের আগে পর্যন্ত নেভে না এই প্রদীপের শিখা। সন্ধি পুজোর দিন ১০৮টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। সন্ধ্যারতির সময়ে ধুনুচি নাচ দেখতে ভিড় জমে বাড়িতে। নবমীর দিন চামুণ্ডা মন্দিরে পরিবার থেকে পুজো পাঠানো হয়। এক দিকে চামুণ্ডা মন্দিরে চলে নিত্যপুজো। অন্য দিকে চলে চৌধুরী পরিবারের নবমী পুজো। দশমী পুজোয় লাগে ১০৮টি অপরাজিতা ফুল ও বেল পাতা। বিসর্জন হয় সকালে। কুমারী পুজোও হয় এ দিন। চলে লাঠিখেলা, সিঁদুর খেলা, নারকেল কাড়াকাড়ির মতো বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান। এছাড়াও রয়েছে একটি বিশেষ রেওয়াজ। তাকে ‘যাত্রা’ বলা হয়। দশমীর দিন পরিবারের কোনও একজন সদস্যকে বেরোতে হয় ‘যাত্রা’য়। চোখ রাখতে হয় আকাশের দিকে। শঙ্খচিল দৃষ্টিগোচর না হওয়া পর্যন্ত চলে দশমী পুজো। পরিবারের সদস্যেরা বলেন, “এমন দিন আসেনি, যে দিন দেবীর কৃপায় শঙ্খচিলের দেখা মেলেনি।”
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পুজোর আড়ম্বর বেশ খানিকটা ম্লান হয়েছে বলে জানালেন পরিবারের সদস্যেরা। আগে পুজোর সময়ে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা নিমন্ত্রিত থাকতেন। কিন্তু এখন তা পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আগের মতো বর্ধমানের রাজবাড়ির তোপধ্বনি শুনে অষ্টমীর পুজোর রেওয়াজও বর্তমানে নেই।
চৌধুরী পরিবারের মতোই মন্তেশ্বরের জোকারিপাড়ার রায়বাড়ির পুজোতেও দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি পূজো হয় না। নবপত্রিকা পুজোর চলই এখানে।গ্রামের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রায় পরিবারের প্রায় ৩৫ ঘর সদস্য। পরিবারের সদস্যেরা জানান, পুজো পরিচালনার জন্য রয়েছে প্রায় ১২০ বছরের পুরনো একটি ট্রাস্টি বোর্ড। যদিও তার অনেক আগে পুজো শুরু হয়। রেওয়াজ মেনে অষ্টমীতে ব্রাহ্মণ ভোজন করানো হয়। নবমীর পঙ্ক্তিভোজে উপস্থিত থাকেন পরিবারের সকল সদস্য। বলি দেওয়া হয় আখ, ছাঁচিকুমড়ো ইত্যাদি সব্জি। পরিবারের সদস্যেরা জানান, এই পুজোকে ঘিরে বছর দশেক আগেও যাত্রা বসত গ্রামে। কিন্তু এখন আর তা হয় না। দশমীতে নবপত্রিকা বিসর্জন দেওয়া হয় খরি নদীতে। পরিবারের সদস্য বিনয়কুমার রায় বলেন, “পুজোর শুরু থেকে কখনও দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি পুজো করা হয়নি। আশা করি, পরবর্তী প্রজন্মও এই রীতি মেনে দেবীর পুজো চালিয়ে যাবেন।” |