এই সময়টায় মাঝে মাঝেই কোনও একটা সংবাদ মাধ্যম (ছাপার জন্য কিংবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য) আমার কাছে এসে জানতে চান, আমাদের অল্প বয়সে দেখা দুর্গাপুজো আর এখনকার পুজোর উৎসবের কী তফাত বলুন তো? এই প্রশ্নটার মধ্যেই প্রচ্ছন্ন আছে যে, আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে। তা তো হয়েছে সত্যিই। আমরা ছাপা অক্ষরের পক্ষপাতী। বৈদ্যুতিন মাধ্যমটিকে ঠিক এখনও রপ্ত করতে পারিনি। অনেক পরিচিত শব্দেরও অর্থ বদলে গেছে। যেমন, বাইট, তার জন্য অবশ্য কারওকে কামড়াতে হয় না। মাউস মানেও কোনও ইঁদুরকে ধরে আনার দরকার নেই। উইন্ডো মানেও জানালা নয়, ইত্যাদি।
যাকে বলে কম্পিউটার-স্যাভি, সেটা আমি আজও হতে পারিনি। আর বোধহয় হবেও না। আমি জীবনের শুরু থেকেই ‘লম্বা হাতে’ (অর্থাৎ কি না ‘লং হ্যান্ড’-এ) লিখি। তার বদলে মুখে কিছু বলতে গেলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। কারণ, তাতে কিছু কিছু ভাষার তফাত হয়ে যায়। তবু মুখের ভাষাতেই সব বলতে হয়। যারা বই-টই নিতে আসে, তারা লেখা-টেখা কিছুই চায় না। গত তিন চার বছর ধরে দেখছি, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে চ্যানেলের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কী সুন্দর স্মার্ট তরুণী-তরুণরা এই কাজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রত্যেক বছরই এই একই প্রশ্নে আমি ঠিক একই রকম উত্তর দিই। এমনকী আমার একটি বইতেও অনেকখানি লেখা আছে। তারা সে সব কিছুই উল্লেখ করে না। হাসি মুখেই চলে যায়। অর্থাৎ তারা ওই সব লেখাটেখা পড়ে না। পড়ার দরকারও মনে করে না। ওদের কাছে সে সব হচ্ছে হার্ড কপি। আমি প্রথম প্রথম ভাবতাম, গদ্য লেখাকেই বুঝি এরা হার্ড কপি বলে, আর কবিতা হচ্ছে সফট কপি। এখন আমি বুঝতে পেরেছি, কম্পিউটারের কাছে গদ্য-পদ্যের কোনও তফাত নেই। ওদের কাছে মুড়ি মিছরি এক দর। |
আমার জন্ম হয়েছিল পূর্ব বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ে। আমার মায়ের মামাবাড়িতে। আমার পিতৃকুল খুবই গরিব। আর মামাবাড়ির ওঁরা বেশ সচ্ছল। ছোটখাটো জমিদারের মতন। এবং তাঁদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বেশ চল ছিল। মায়ের এক মামার নাম সুরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়। ওই রকম সামান্য গ্রামে লেখাপড়া শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত হয়েছিলেন ডি এস সি। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্ক বিভাগের প্রধান। ত্রিকোণমিতি নিয়ে পাঠ্যবইও লিখেছিলেন। তাঁর ছেলেরাও ছিল উচ্চশিক্ষিত। অন্তত এম এ পাশ না-করলে তাঁরা কাউকেই ঠিক শিক্ষিত বলে গণ্য করতেন না। সে জন্যই মা আমার আফসোস করে বলতেন, আমার ভাইরা সব এম এ পাশ। আর আমার ছেলেরা... তুই এম এ পর্যন্ত পড়বি না? আমি তখন গ্র্যাজুয়েট হয়ে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করব না ঠিক করেছিলাম।
যাক সে সব কথা, মানুষ নিজের জীবনের অনেক ঘটনা আস্তে আস্তে ভুলে যেতে শুরু করে। আবার কিছু কিছু স্মৃতি যেন খোদাই করার মতন চিরকাল থেকে যায়। মামাবাড়িতে খুব ধুমধাম করে পুজো হত। সেই সময়কার দু-তিনটি স্মৃতি বেশ মনে আছে। অনেক দুঃখের ঘটনা পরবর্তী জীবনে আস্তে আস্তে বেশ মধুর হয়ে আসে। আমার অবশ্য একটি ঘটনা এখনও একটা তিক্ত স্বাদ এনে দেয়।
পুজোর মাসখানেক আগেই চারটে ছাগলছানা কিনে আনা হত হাট থেকে। তারপর আমাদের মতো কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়েকে ভার দেওয়া হত সেগুলো দেখাশোনা করার। আমরাও প্রবল উৎসাহে তাদের ঘাস খাওয়াতাম। ছোটাছুটি করে খেলতাম ওদের সঙ্গে। ওদের একটা করে নামও দেওয়া হত। তারপর যথারীতি পুজোর দিনে বলি দেওয়া হত তাদের। সপ্তমী ও নবমীর দিন একটি করে, অষ্টমীর দিন দুটি। একটা বছরের কথাই মনে আছে। তখন আমার বয়স এগারো। যথারীতি চারটে পাঁঠাকে এক মাস ধরে লালন পালন করেছি। সপ্তমীর দিন একটা পাঁঠাকে হাঁড়িকাঠে চড়ানো হয়েছে, আর্ত চিৎকার করছে সে। হঠাৎ আমার বুকে যেন একটা ধাক্কা লাগল। দু-চোখ বেয়ে ঝরঝরিয়ে নেমে এল কান্না।
আমি তখনই একটা দৌড় লাগালাম। পুজো মণ্ডপ ছাড়িয়ে, পাকা বাড়িটার পাশ দিয়ে, উঠোনটা পেরিয়ে, রান্নাঘরের ডান পাশে একটা সরু গলির ভিতর দিয়ে আরও কিছুটা ফাঁকা জমির ও-ধারে একটা বড় বাঁশঝাড়। সেখানেই আমার লুকিয়ে থাকার জায়গা। সেখানে বসে আমি কাঁদতে লাগলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। খানিক বাদে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এক মামা এসে পড়লেন সেখানে। তিনি কোনও ব্যস্ততা দেখালেন না। আমাকে কোনও বকুনিও দিলেন না। একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। সিগারেটটা শেষ করার পর তিনি বললেন, তুই যে এত কাঁদছিস, তার মানে বুঝলি? আজ থেকেই শুরু হল তোর বড়দের জগতে ঢুকে পড়া। আস্তে আস্তে বুঝতে পারবি, বড়দের জগৎটায় হিংসে ও নিষ্ঠুরতা আরও কত বেশি।
বড়দের জগতে পুরোপুরি ঢুকে পড়ার পরও আমার মনে বার বার এই প্রশ্ন জেগেছে, আমার ওই মামাবাড়ির অধিকাংশ পুরুষেরা উচ্চশিক্ষিত হয়েও বলিদান প্রথা সমর্থন করতেন কেন? শিক্ষাও কি মানুষের মন থেকে অনেক রকম কুসংস্কার দূর করতে পারে না?
দেশভাগের পর সেই গাঙ্গুলি পরিবার সেখানকার বাড়ি-ঘর ও সম্পত্তি ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। এখানেও তাঁরা দুর্গাপুজো বহাল রেখে দেন। কিন্তু বলিদান বন্ধ হয়ে
যায়। অবশ্য কোনও আদর্শ মেনে নয়, নিতান্তই বাস্তব কারণে।
আমার গ্রামে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় চোদ্দো বছর বয়সে। সেই বয়সটায় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার কথা। তাই-ই তো করেছি নিষ্ঠার সঙ্গে। তার দু-তিন বছর পরেই কিন্তু মানসিকতা অনেকখানি বদলে যায়। তখন মণ্ডপে ঠাকুর দেখা হত এক ঝটকায়। তার পরই দু-চোখ খুঁজত জ্যান্ত সুন্দরী কিশোরীদের। তখন মাইক্রোফোনে ঘোষণা করতে হত, শ্রীমতী ছবিরানি বিশ্বাস, শোনো, তুমি যেখানেই থাকো, আমাদের অফিস ঘরে চলে এস। তোমার পিসেমশাই অপেক্ষা করছেন।
কিন্তু ছবিরানি সেখানে আসবে কী করে? সে তো তখন আরও দুই বান্ধবীর সঙ্গে গঙ্গার ধারের রাস্তায়। সেখানে আমি ও আর দু’জন অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তাদের মনোরঞ্জনের জন্য।
আমরা মেয়েদের কাছে দয়া চাইতাম। কখনও কখনও তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দু-একটা ব্যাপারে সম্মতি আদায় করতেও আপত্তি ছিল না। আমরা ছিলাম ভালবাসার কাঙাল। সেই কাঙালপনাকেও আমরা তৈরি করে নিতাম কিছুটা প্রশ্রয় পাওয়ার জন্য। কোনও মেয়ের শরীর স্পর্শ করার জন্য গায়ের জোর ফলানো ছিল আমাদের চিন্তার অতীত।
এখন ছেলেমেয়েদের মেলামেশার কত সুযোগ রয়েছে। ও-রকম লুকোচুরির কোনও দরকারই নেই। তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই যে ভালবাসা পাওয়ার জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা, তা এ-কালে বরবাদ হয়ে যায়নি নিশ্চয়ই। |