তৃতীয় বারের জন্য ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হইলেন উগো চাভেস। তাহার আগেই অবশ্য তিনি এই মর্মে দেশের সংবিধান সংশোধন করাইয়া লন যে, প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার কোনও সর্বোচ্চ সীমা নাই, তিনি যত বার খুশি এই পদে দাঁড়াইতে পারেন। আমৃত্যু দেশবাসীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা থাকার এই বন্দোবস্তকেও তাঁহার সমর্থকরা ‘গণতন্ত্র’ বলিয়া অভিনন্দিত করিয়া থাকেন! সেই সমর্থক তালিকায় এই বঙ্গের বামপন্থীরাও আছেন। বস্তুত, চাভেসের এই ক্ষমতালোলুপতা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নিরবচ্ছিন্ন কর্তৃত্বপরায়ণতার সহিত তুল্য। বোধ হয় পশ্চিমী গণতন্ত্রের গা ঘেঁষিয়া থাকিতে হয় বলিয়া পুতিন দুই বার প্রেসিডেন্ট, তাহার পর এক বার প্রধানমন্ত্রী, তাহার পর আবার দুই মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট ইত্যাকার সাংবিধানিক বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছেন। চাভেসের সেই দায়ও নাই।
ভেনেজুয়েলায় চাভেসের সবে তেরো বছর পূর্ণ হইল। আগামী জানুয়ারিতে আরও ছয় বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ শুরু হইবে। তাহার শেষে হয়তো পুতিনের নিয়তি চাভেসকেও তাড়া করিতে শুরু করিবে। বস্তুত, এ বারের নির্বাচনেই চাভেস রীতিমত শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হন। চাভেসের জনপ্রিয়তা যে আর আগের মতো উত্তুঙ্গ নয়, এই ফলাফল তাহার প্রমাণ। বিপুল তৈলসম্পদের ভাণ্ডার মজুত থাকা সত্ত্বেও ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির স্বাস্থ্য বিশেষ ভাল নয়। তাহার কারণ ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’ অনুশীলন করিতে বদ্ধপরিকর চাভেস জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতার শক্তিকে রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণের নিগড়ে। অদূর ভবিষ্যতে ব্যক্তিমালিকানাধীন আরও বহু সম্পত্তি, শিল্পোদ্যোগ ও ব্যবসায়ের তিনি রাষ্ট্রীয়করণ করিতে কৃতসঙ্কল্প। পুঁজির বিকাশ ও স্ফূর্তির সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনাশ করিতে উদ্যত চাভেস হয়তো এ জন্য কিউবা ও নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রশংসা পাইবেন, কিন্তু ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি তাহাতে চাঙা হইবে না। অর্থনীতিবিদরা ইতিমধ্যেই ভেনেজুয়েলায় মন্দার আশঙ্কা করিতেছেন।
এই দুই বন্ধুরাষ্ট্রকেই তিনি ভর্তুকিতে অর্থাৎ বাজার দরের তুলনায় অনেক কম দামে তেল সরবরাহ করেন, যেমন করেন লাতিন আমেরিকার আরও কিছু সমমনা রাষ্ট্রনায়ককে। ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিরুদ্ধে তাঁহার দন কিহোতে-সুলভ আস্ফালন হয়তো তাঁহাকে তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দুনিয়ার কাছে নায়কের মর্যাদায় ভূষিত করিয়াছে, কিন্তু তাঁহার স্বদেশ ভেনেজুয়েলায় দারিদ্র ও শিক্ষাহীনতা দূর করার জরুরি কর্মকাণ্ডে তিনি এখনও তত মনোযোগী নন। তবে তাঁহার নিজস্ব ঘরানার সমাজতন্ত্র অনুশীলন করিতে তিনি দেশে ‘কমিউন’-এর সংখ্যা বাড়াইতে চাহেন, জনসাধারণের ত্রাণে সরকারি ব্যয়ও বাড়াইতে প্রস্তুত। অচিরেই তাঁহাকে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাইতে হইবে, যাহার ফলে মুদ্রাস্ফীতি অনিবার্য। উপরন্তু চাভেস খুব সুস্থও নন। তাঁহার স্বাস্থ্যের অবনতি হইলে কেবল তাঁহারই মুখের দিকে চাহিয়া থাকা প্রশাসন কেমন করিয়া দেশে আইনের শাসন কায়েম রাখিবে, সেটা একটা সমস্যা। ব্যক্তিগত কোনও উত্তরাধিকারী তাঁহার নাই, ভাইস-প্রেসিডেন্ট বা অন্য কাহারও নেতৃত্বের বৈধতা নাই। গণতন্ত্রের মোড়কে যে-কোনও স্বৈরাচারী যে ভাবে শাসন পরিচালনা করেন, চাভেস তাহাই করিতেছেন। তাই এই নির্বাচনী বিজয় শেষ কথা নয়। |