পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রবীন্দ্রভক্ত। কিন্তু ভক্তির আতিশয্যে যদি রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীকে আক্ষরিক অর্থে মানিয়া চলিতে আরম্ভ করেন, তবে মুশকিল। সংশয় হইতেছে, বাণিজ্যে যাওয়ার প্রবল বাসনায়, এবং রবীন্দ্রসংগীতের সক্রিয় অনুপ্রেরণায়, তিনি লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর প্রভেদ গুলাইয়া ফেলিয়াছেন। নয়াচর নামক ভূখণ্ডটি শিল্পায়নের প্রশ্নে নেহাতই ‘অলক্ষ্মী’ ওই জমিতে শিল্প সম্ভব নহে। বামফ্রন্ট সরকার সেখানে পেট্রোলিয়াম হাব গড়িবার ইচ্ছা করিয়াছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ৯৩,০০০ কোটি টাকার প্রকল্পও মঞ্জুর করিয়াছিলেন। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার তৎকালীন বিরোধী অবতারে সেই শিল্প সম্ভাবনার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। সম্ভবত তাঁহার একমাত্র যথার্থ বিরোধিতা। কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে তিনি বিরোধিতায় থামেন নাই, বিকল্প শিল্পপ্রস্তাব করিয়াছিলেন। তিনি নয়াচরে শিল্প পার্ক, বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পরিবেশ বান্ধব পর্যটন কেন্দ্র গড়িতে চাহেন। যে জমিতে পেট্রোলিয়াম হাব হওয়া সম্ভব নহে, তাহাতেই কী উপায়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হইতে পারে, মুখ্যমন্ত্রী বলেন নাই। তিনি বলুন আর না-ই বলুন, নয়াচরে কোনও শিল্পই হইতে পারে না। এমনকী পর্যটন শিল্পও নহে। কলিকাতা হইতে ২০০ কিলোমিটার উজাইয়া কয় জন পর্যটক নয়াচরে চারটি গাছ ও কয়েক ডজন ব্যাঙাচির নৃত্য দেখিতে যাইবেন? তাঁহাদের যাতায়াতের জন্য যে সেতুটি গড়িতে হইবে, শুধুমাত্র সেই খরচ কয় যুগে উঠিবে, মুখ্যমন্ত্রী হিসাব করিয়াছেন কি?
শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করিয়াছেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাঁহার সাধের প্রকল্পের পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইতেছে। যদি অভিযোগটি সত্য হয়, তবে কেন্দ্রীয় সরকারকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানানো রাজ্যবাসীর কর্তব্য। যাহা হয় না, তাহাকে লইয়া কালাতিপাত করা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকদের ধর্ম। তাহারই একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ নয়াচরের জনহীন ভূখণ্ডের অদূরে রহিয়াছে। তাহার নাম হলদিয়া। বন্দরটি যেখানে অবস্থিত, নিছক ভৌগোলিক কারণেই সেখানে বন্দর হওয়া সম্ভব নহে। নদীর খাত ক্রমে বদলাইয়াছে, নদী নাব্যতা হারাইয়াছে। এই অবস্থানে বন্দর থাকিলে মৃত্যুই তাহার একমাত্র পরিণতি। হলদিয়া সেই পথেই চলিয়াছে। কিন্তু হলদিয়ার উদাহরণ হইতে দৃশ্যতই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করেন নাই। তিনি নয়াচরে আরও একটি ‘অসম্ভব’-এর পশ্চাদ্ধাবন করিতে চাহেন। মুখ্যমন্ত্রীকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাউক, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অবস্থা ভাল নহে। এই অবস্থায় টাকা উড়াইবার শখ শোভা পায় না। নয়াচরে শিল্প হওয়ার নয়। সেই সোনার হরিণের আশা না করাই বিধেয় এমনকী কবি তাঁহার গানে সেই বাসনা প্রকাশ করিলেও। দুর্ভাগা এই রাজ্য। যাহা নাই তাহার শোকে যাহা ছিল তাহাও ঘুচিয়া যাইতেছে। নয়াচর বা হলদিয়া এই রাজ্যের জন্য নহে। এই রাজ্য মেধাসম্পদে বিত্তবান। সেই সম্পদের প্রকৃত ব্যবহারই পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির পথ। তাহার জন্য এক দিকে যেমন শিক্ষা পরিকাঠামো প্রয়োজন, শিক্ষাক্ষেত্রকে রাজনীতিমুক্ত রাখা প্রয়োজন, অন্য দিকে প্রয়োজন মেধানির্ভর শিল্পের আবাহন। বামপন্থীরা দীর্ঘ দিন বিপরীত বিহার করিয়াছিলেন, এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই পথেরই পথিক হইয়াছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে শঙ্কুদেব পণ্ডা আর আরাবুল ইসলামদের আধিপত্য কায়েম হইয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বসিতে হইলে কোন দিকে রাজনৈতিক আনুগত্য চাই, তাহাও স্পষ্ট জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। আর মেধানির্ভর শিল্পকে কুলার বাতাস দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর জেদই যথেষ্ট। শিল্প থাকিলে থাকুক, গেলে যাউক, মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার জেদ ছাড়িবেন না। যাহা সম্ভব, তাহাকে তিনি বিদায় জানাইবেন আর যাহা অসম্ভব, তাহা লইয়া কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ করিবেন পশ্চিমবঙ্গের অধোগতির জন্য আর কী চাই? |