প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় গত কয়েক বছর ধরেই দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা অনিয়মিত। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। এই পরিস্থিতিতে বৃষ্টির মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে চাষের ধরন-ধারন বদলের কথা কৃষি বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু দিন ধরেই বলে আসছেন। ‘জিরো টিলেজ’ বা জমি না চষে (কর্ষণ) ধান চাষের পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে সেই সমস্যার মোকাবিলা করার কথা ভাবছেন তাঁরা। হুগলি জেলার বলাগড়ে এই পদ্ধতির চাষ ইতিমধ্যেই সাফল্যের মুখ দেখিয়েছে চাষিদের। ‘জিরো টিলেজ’ পদ্ধতি কী? ধান চাষের জন্য বীজ বপণ করে ‘বীজতলা’ তৈরি করতে হয়। সেই বীজ রোপণ করা হয় জমিতে। বীজতলা তৈরিতে প্রচুর জল লাগে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে সেচের জল কিনতে হয়। ‘জিরো টিলেজ’ মেশিন ব্যবহার করলে ‘বীজতলা’ তৈরিরই দরকার হয় না। জমি কর্ষণেরও প্রয়োজন নেই। বিশেষ ধরনের ধানের বীজ মেশিনের সাহায্যে সরাসরি বপণ করা যায়। জল লাগে অনেক কম। ছিটেফোঁটা বৃষ্টিতেও কাজ হয়ে যায়। বীজ বপণের পাশাপাশি একই সঙ্গে সারও ছড়ানো যায় জমিতে।
গুজরাত, পঞ্জাব, হরিয়ানায় ইতিমধ্যেই ‘জিরো টিলেজ সিড কাম ফার্টিলাইজার ড্রিল’ নামে এই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল মিলেছে বলে জানিয়েছেন এ রাজ্যের কৃষিকর্তারা। ঝাড়খণ্ড, বিহারেও বিচ্ছিন্ন ভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে। রাজ্য কৃষি দফতর সূত্রের খবর, চলতি বছরে বলাগড়ের সোমরা, বর্ধমানের জামালপুর, বর্ধমান সদরের আমড়া-সহ উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ, নকশালবাড়ি, কোচবিহারে ‘জিরো টিলেজ’ পদ্ধতিতে ধান চাষ করা হয়েছে। সুন্দরবনের গোসাবাতেও চলতি মরসুমে এই পদ্ধতিতে চাষ শুরু হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “রাজ্যের কয়েকটি জেলার চাষিরা চাষের এই পদ্ধতিতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। চাষে জল কম লাগে। খরচও কম। চাষিদের মধ্যে এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
|
সামনে সাধারণ ভাবে চাষ। পিছনে ‘জিরো টিলেজ’ পদ্ধতিতে চাষ। |
কৃষি দফতর সূত্রের খবর, হুগলির বলাগড়ের সোমরা ২ পঞ্চায়েতের মশড়া এবং বাকুলিয়া পঞ্চায়েতের ধোবাপাড়া গ্রামে চলতি মরসুমে (আমন) নতুন এই পদ্ধতিতে ধান চাষ করা হয়েছে। ‘রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা’য় মশড়া সমবায় সমিতিকে বিনামূল্যে একটি ‘ড্রিল মেশিন’ দেওয়া হয়েছে। যন্ত্রটির দাম প্রায় ৯০ হাজার টাকা।
বলাগড়ের ধোবাপাড়া গ্রামের শ্যামল মুখোপাধ্যায়, মন্টুলাল পোদ্দার এবং মশড়া গ্রামের অসীম মালিক নতুন পদ্ধতিতে ধান চাষ করেছেন। তাঁরা জানালেন, জলের প্রয়োজন কম থাকায় এই চাষে প্রকৃতির উপরে নির্ভরতা কমে। সময় মতো পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলেও চাষ হতে পারে। বীজতলা তৈরির প্রয়োজন না থাকায় কৃষিমজুর কম লাগে। চিরাচরিত পদ্ধতির ধান চাষে ফসল ঘরে তুলতে ১৬০-১৭০ দিন সময় লাগে। নতুন পদ্ধতিতে চাষ করলে সময় লাগে ১৪০ দিন। কম সময় লাগায় সেই জমি অন্য চাষে ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া, এক বিঘে জমিতে মাত্র ২ কিলোগ্রাম বিশেষ ধরনের ধানের বীজ লাগে, যার মূল্য ৬০ টাকা। চলতি ধানের বীজের খরচের তুলনায় এই টাকা অনেক কম। চলতি চাষে এক বিঘে জমিতে (সেচের খরচ সমেত) ৪৮০০ টাকা খরচ লাগে। নতুন পদ্ধতিতে বিঘে-প্রতি প্রায় ৬০০ টাকা কম লাগছে বলে জানালেন চাষিরা।
বলাগড়ের কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক জয়দেব হালদার বলেন, “নতুন এই পদ্ধতির চাষে প্রচুর সাড়া মিলছে। আগামী মরসুমে পুরো বলাগড় ব্লকেই এই পদ্ধতির চাষ মানুষ বেছে নেবেন বলে মনে হচ্ছে।” বলাগড়ের সহ-কৃষি অধিকর্তা অনিরুদ্ধ দত্ত বলেন, “এই চাষে যে বিশেষ ধরনের ধানের বীজ ব্যবহার হয়, বৃষ্টি কম হলেও প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। কম জলে ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ইদানীং প্রকৃতি যেমন খামখেয়ালি আচরণ করছে, তাতে এই বিশেষ ধরনের চাষের পদ্ধতি খুবই উপযোগী।” হুগলি জেলার অন্যতম কৃষি অধিকর্তা রঞ্জন দাসের কথায়, “শ্যালো, মিনি ডিপ-টিউবওয়েল অতিরিক্ত ব্যবহারে জলস্তর নেমে যাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে জল কম লাগায় মাটির নিচে জলস্তর ঠিক থাকবে। বিদ্যুৎ এবং তেলেরও সাশ্রয় হয়।”
|
নতুন কায়দার পাঁচকাহন |
• চিরাচরিত পদ্ধতির তুলনায় ৩০ শতাংশ কম জল লাগে।
• ধানের বীজতলা তৈরি করতে হয় না।
• লাঙল বা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি তৈরি করতে হয় না।
•কৃষি-শ্রমিক কম লাগে।
• সময়ও কম লাগে। সব মিলিয়ে চাষের খরচ কমে।
সামনে সাধারণ ভাবে চাষ। পিছনে ‘জিরো টিলেজ’ পদ্ধতিতে চাষ। |
|
কেন্দ্রীয় সরকারের ‘রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা’র আওতায় সমবায় সমিতিগুলিকে আপাতত বিনা খরচেই ‘জিরো টিলেজ’ মেশিন দেওয়া হচ্ছে। চাষিদেরও ভাড়া গুনতে হচ্ছে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কী প্রকৃতির উপরে নির্ভরতা কমলেও সরকারের উপরে নির্ভরতা বাড়বে? হুগলি জেলা সহ কৃষি অধিকর্তা গৌরকুমার সিংহ বলেন, “এটা সরকারের পাইলট প্রোজেক্ট। আপাতত বিনা খরচেই তা পাওয়া যাবে। পরে সমবায় সমিতিগুলি নিজেরাই মেশিন কিনতে পারেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিনলে সরকারি ভর্তুকিও মিলবে।” |