শেষ পর্যন্ত শিকে ছিঁড়ল। এ বছর বিশ্বের প্রথম দশ উদ্ভাবকের মধ্যে স্থান পেলেন অসমের উদ্ধব ভরালি। নাসার তরফে বিশ্বের জনপ্রিয় আবিষ্কারগুলি নিয়ে বার্ষিক অনলাইন প্রতিযোগিতায় নিজের বিভাগে সবচেয়ে বেশি ভোট পান লখিমপুরের উদ্ধববাবু।
দৈনন্দিন খুঁটিনাটির ভিতর থেকেই, অতি প্রয়োজনীয়, চমকে দেওয়ার মতো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের আবিষ্কারই উদ্ধববাবুর নেশা। এখন অবধি প্রায় ৯৮টি এমন যন্ত্র তাঁর মাথা থেকে বের হয়েছে। আরও অন্তত শ’খানেক যন্ত্রের চিন্তা ও নক্শা গিজগিজ করছে মাথার ভিতরে। ইতিমধ্যে ২০০৭ সালে ‘নিফ’-এর ‘সৃষ্টি সম্মান’, ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার এবং ২০১০ সালে প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি ‘চেয়ার শৌচাগার’-এর হাত ধরে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান মন্ত্রকের ‘মেধাবী আবিষ্কার’-এর খেতাব তাঁর ঝুলিতে ঢুকেছে। তাঁর আবিষ্কার করা যন্ত্রের সিংহভাগই আম-আদমির জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। শৈশবে অনাহার ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা উদ্ধববাবু স্বপ্নের উড়ানে গা ভাসাতে রাজি নন। তিনি বলেন, “নিজের কষ্টের সময় যে সব জিনিসের অভাব বোধ করেছি, যা কঠিন মনে হয়েছে, আবিষ্কারের নেশা চাপলে সেই সব কঠিনকে সরল করার দিকেই আগে মন দিই।
|
উদ্ধব ভরালি। ছবি: উজ্জ্বল দেব |
বাদামের খোসা ছাড়াবার যন্ত্র, বেতের ছিলা ছাড়াবার যন্ত্র, ফল থেকে বীজ বের করবার যন্ত্র, চা-পাতা প্রক্রিয়াকরণ করার যন্ত্র, ইট তৈরির কল, ফল থেকে শাঁস ও রং বের করার যন্ত্র বা তামাক পাতা কাটার যন্ত্রের মতো সাধারণ হয়েও অসাধারণ, অথচ কার্যকর উদ্ভাবনের জনক উদ্ধববাবু। তাঁর ৯টি যন্ত্র ইন্দোনেশিয়া, ইথিওপিয়া, কিনিয়া, আমেরিকা, তুর্কিসহ নানা দেশে রফতানি হয়। গুয়াহাটি আইআইটির সঙ্গে তিনি যুক্ত। তবু লখিমপুরের ভূমিপুত্র উদ্ধব ভরালি নিজেকে এখনও কৃষক বলেই পরিচয় দেন।
উদ্ধববাবুর প্রথম আবিষ্কারই ছিল ‘হিট’। আশপাশের চা বাগানের জন্য মাত্র ৬৭ হাজার টাকায় পলিথিন ফিল্ম বানাবার যন্ত্র বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। বাজারে এই যন্ত্রের দাম পড়ে ৪ লক্ষ টাকা। ওই যন্ত্রের সৌজন্যে বাবার ঋণের বোঝা ঘাড় থেকে নামিয়ে উদ্ধববাবু পুরোদমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তবে তাঁর আবিষ্কৃত সব যন্ত্রই অবশ্য সফল নয়।
সম্প্রতি ডালিম-বেদানার খোসা ছাড়িয়ে দানা বের করার যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন তিনি। আর সেই সুবাদেই, নাসার ‘ক্রিয়েট দ্য ফিউচার’ প্রতিযোগিতায় তাঁর মনোনয়ন ও জয়লাভ। একই সঙ্গে ২০১২ সালের বিশ্ব প্রযুক্তি সম্মানেও তিনি মনোনীত হয়েছেন। তাঁর ‘বেঞ্চটপ পমগ্রেনেট ডিসিডার’ যন্ত্রটি ‘মেশিনারিজ্ অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট’ বিভাগে সবচেয়ে বেশি ভোট পায়। প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বের আরও ২৫ আবিষ্কর্তা। নাসার নিয়মানুযায়ী, অনলাইন ভোটের মাধ্যমে জয়ীকে বেছে নেওয়া হয়েছে। উদ্ধবের যন্ত্র ঘণ্টায় ৫৫ কিলোগ্রাম বেদানা বা ডালিমের দানা বার করতে পারে। আমেরিকায় রফতানি হওয়া এই যন্ত্র বেশ জনপ্রিয়। গত সপ্তাহে পুণের ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনোভেশন কনফারেন্সে’ উদ্ধব সম্মানিত হন।
নেই নেই করেও অনেক স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর। বহু ব্যঙ্গ, টিটকিরি সহ্য করে মিলেছে আন্তর্জাতিক সম্মান। ‘নাসা’র স্বীকৃতিও জুটল। আর কী চাওয়ার বাকি আছে? তাঁর স্বপ্ন, এক অনাথ আশ্রম গড়বেন। সেখানে ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তিগত শিক্ষা দেওয়া হবে। নিজেরা মাথা খাটিয়ে নানা জিনিস তৈরি করবে। সঙ্গে চলবে অঙ্ক, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, ভাষাবিদ্যা ও বিজ্ঞানের পাঠ। নানা প্রযুক্তিকে এক ছাদের তলায় এনে বয়স্কদের জন্য ‘প্রযুক্তি-গ্রাম’ গড়তে চান তিনি।
বন্যা বিধ্বস্ত অসমের সীমাবর্তী জেলাসদর না হয়ে, প্রেক্ষাপটে ধূসর হিমালয়, নীল হ্রদ আর বরফের অনুষঙ্গ থাকলে উদ্ধব ভরালির নাম ‘ফুংসুক ওয়াংড়ু’ হতেই পারত। |