সজলধারায় ১০ কোটির দুর্নীতি, অভিযুক্ত সিপিএম
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের আওতায় থাকা গ্রামাঞ্চল ও চা-বাগান এলাকায় ‘সজলধারা’ প্রকল্পে আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। ওই প্রকল্পে সহায়কের ভূমিকায় থাকা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার যোগসাজশে সরকারি টাকার অপব্যবহার হয়েছে এই মর্মে অভিযোগ পৌঁছেছে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকে। রাজ্য সরকারের মাধ্যমে মন্ত্রক তা নিয়ে তদন্তের নির্দেশও দিয়েছে।
ঘটনায় জড়িয়ে গিয়েছে একাধিক সিপিএম নেতা-নেত্রীর নামও। যদিও মহকুমা পরিষদের বর্তমান সভাধিপতি তথা সিপিএম নেতা পাসকেল মিন্জের দাবি, “শিলিগুড়িতে ২৮টি প্রকল্পের কাজ ওই সংস্থার মাধ্যমেই হয়েছে। ২৭টিতে জল সরবরাহে ছোটখাটো ত্রুটি হলেও দুর্নীতি হয়নি। প্রকল্পগুলির দায়িত্ব কেউ নিতে চাইছে না। ওই সংস্থা না থাকলে তো জল দেওয়াই বন্ধ হয়ে যাবে।” তবে দার্জিলিঙের জেলাশাসক তথা শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের এগজিকিউটিভ অফিসার সৌমিত্র মোহন বলেছেন, “সজলধারা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি নজরে রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পরিষদ সূত্রে জানা যাচ্ছে, শিলিগুড়িতে ২০০৬ সালে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বরাদ্দ হয় প্রায় ৩১ কোটি টাকা। ২৮টি জায়গা বাছাই করে স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রধান বা উপপ্রধানদের চেয়ারম্যান করে ‘ভিডব্লুএসসি’ (ভিলেজ ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন কমিটি) গড়া হয়। কমিটিগুলিকে সাহায্য করতে ‘ফাটাপুকুর রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দায়িত্ব পায়। বিধি মোতাবেক, প্রকল্প রূপায়ণের পরে এক বছর তা চালিয়ে কমিটির হাতে পুরো দায়িত্ব তুলে দেবে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে সম পরিমাণ অনুদানের টাকা ব্যাঙ্কে রেখে তার সুদে প্রকল্পটি চালাবে কমিটি। অথচ বাস্তব হল, একটি প্রকল্পও কোনও কমিটিকে হস্তান্তর করা হয়নি।
সভাধিপতির বাড়ির সামনে এ ভাবেই পড়ে রয়েছে প্রকল্পের সরঞ্জাম ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
প্রশাসনের কাছে গ্রামবাসীদের যে অভিযোগ পৌঁছেছে, তাতে দাবি করা হয়েছে স্রেফ সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম ঘোষের লিখিত সুপারিশে ‘ফাটাপুকুর রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’কে সহায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন তৎকালীন মহকুমা সভাধিপতি মণি থাপা। তখন সহকারী সভাধিপতি ছিলেন বর্তমান সভাধিপতি পাসকেলবাবু। অভিযোগ, সিপিএম নেতাদের একাংশের প্রশ্রয় রয়েছে বলেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি প্রকল্প রূপায়ণের সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই বিধি অমান্য করেছে। পাম্প হাউসের জমি সংগ্রহ, পাম্প বসানো, বোরিং নলকূপের সংখ্যা কমানো, নিম্নমানের পাইপ, ট্যাঙ্ক ব্যবহার, আসবাবপত্র কেনা, রক্ষণাবেক্ষণ সব মিলিয়ে অন্তত ১০ কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে বলে অভিযোগকারীদের আশঙ্কা। শুধু তা-ই নয়, ফাঁসিদেওয়ার একাধিক প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দাবি জানানো সত্ত্বেও সেখানে সজলধারা প্রকল্প হয়নি। অথচ, শিলিগুড়ি লাগোয়া মোহরগাঁও-গুলমার মতো চা-বাগানে একযোগে ৭টি সজলধারা প্রকল্প হয়েছে। কেন এমন সিদ্ধান্ত হল, তা খতিয়ে দেখারও দাবি উঠেছে।
যে সব জায়গায় প্রকল্প হয়েছে, সেখানকার মানুষ কী বলছেন? খোদ সভাধিপতির বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রাঙালি মৌজায় প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচে হয়েছে একটি প্রকল্প। মহাদেব মাহাতোর বাড়িতে পাম্প হাউস। মহাদেব অস্থায়ী ভাবে পাম্প চালানোর কাজ করেন। তিনি বললেন, “বাড়ির এক জনকে চাকরি দেওয়া হবে, এই শর্তে জমিটা বিনামূল্যে দিয়েছি। এখন মাসে দেড় হাজার টাকা করে পাই। ৬টি ট্যাঙ্ক। একটা ট্যাঙ্ক ফেটে গিয়েছে। আয়রন প্ল্যান্ট চালু হয়নি। স্ট্যান্ডপোস্টের নীচে পাকা নিকাশি হয়নি। বেশিক্ষণ পাম্প চালালে গেরস্তের বাড়ির সামনে জল জমে যায়। গালাগাল দেয়। ফলে, জল বন্ধ করে দিই।” একই অভিযোগ নকশালবাড়ি, মাটিগাড়ার গ্রামেও।
চা-বাগানে সজলধারার হাল আরও করুণ। সোনাচান্দি, গঙ্গারাম, কিরণচন্দ্র চা-বাগানের ঘরেঘরে প্রকল্পটি নিয়ে বেনিয়মের অভিযোগ। মোহরগাঁও গুলমা চা-বাগানে ৭টি সজলধারা প্রকল্প হয়েছে। কমিউনিটি ট্যাঙ্ক হাসপাতালের বাগানের মধ্যে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। আবার হাঁসখোয়া চা-বাগানে চোখে পড়ল, টিন দিয়ে জলাধার তৈরি করে তা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা রয়েছে। মোহরগাঁও-গুলমার বাগানের ম্যানেজার স্বপন গুহর দাবি, “৭টি প্রকল্পেই নানা সমস্যা।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, মাটির যতটা গভীরে পাইপ পোঁতা উচিত, আদৌ তা হয়নি। আবার অনেক জায়গায় যত লিটার আয়তনের জলাধার গড়ার কথা, তার চেয়ে অনেক কম জলধারণক্ষমতা সম্পন্ন জলাধার তৈরি হয়েছে। জেনারেটর দিয়ে পাম্প চালানোর নিয়ম না থাকলেও, তা করা হচ্ছে। সার্বিক কাজও নিম্নমানের হয়েছে বলে অভিযোগ। সে জন্যই বুড়াগঞ্জের রণজিৎ বর্মন থেকে শুরু করে চম্পাসারি পঞ্চায়েতের সদস্য তীর্থরাজ শর্মার বক্তব্য, “প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তদন্ত জরুরি।” ঘটনা হল, প্রশাসনও এই অভিযোগ পেয়ে ইতিমধ্যেই নড়েচড়ে বসেছে। সভাধিপতি বহু বার বলা সত্ত্বেও ওই প্রকল্প বাবদ বকেয়া ১০ শতাংশ টাকার (প্রায় ৩ কোটি টাকা, যা ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পাওয়ার কথা তাদের খরচ হিসাবে) ফাইলে সই করতে রাজি হননি মহকুমা পরিষদের অতিরিক্ত কার্যনির্বাহী আধিকারিক (এইও) সুবল রায়। সভাধিপতির ক্ষোভ, “সে জন্য পরের ২৫টি সজলধারা প্রকল্পের বরাদ্দ মেলার প্রক্রিয়া থমকে রয়েছে।” সুবলবাবুর কথায়, “অভিযোগ উঠলে তদন্ত শেষের আগে বাদবাকি বরাদ্দ দেওয়া ঠিক নয়।” তবে প্রশাসন সূত্রের খবর, বিষয়টি নিয়ে প্রায় রোজই মতবিরোধের জেরে মহাকরণে চিঠি লিখে বদলি চেয়েছিলেন সুবলবাবু। তাঁর আর্জি মঞ্জুর হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির অবৈতনিক সচিব সর্বাণী ধাড়ার দাবি, “টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের সংস্থার সঙ্গে একদা যুক্ত ছিলেন, এমন কিছু লোকই প্রতিহংসাপরায়ণ হয়ে উল্টোপাল্টা অভিযোগ করে বেড়াচ্ছেন। আমরা কত কষ্ট করে কাজ করছি সেটা সকলে বুঝবেন না। সভাধিপতি আমাদের সমস্যা বোঝেন।” কিন্তু অনুমোদিত প্রকল্প-প্রস্তাবে যা রয়েছে, সেই অনুযায়ী সর্বত্র কাজ হয়নি কেন? সর্বাণীদেবীর যুক্তি, “গ্রামে কাজ করা কত কষ্টসাধ্য সেটা বুঝতে হবে। তা-ও বলতে পারি, যেখানে যা ত্রুটি রয়েছে বকেয়া টাকা পেলেই সে কাজ হবে।”
ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নাম সুপারিশ করার কথা মনে করতে পারছেন না সিপিএম নেতা গৌতমবাবু। তাঁর কথায়, “আমি এ কথা মনে করতে পারছি না। তবে সংস্থাটি আমাদের এলাকায় কাজ করেছে। সেই সুবাদে ওদের চিনি।” প্রাক্তন সভাধিপতি মণি থাপাও বলেছেন, “নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনেই সংস্থাটিকে বাছাই করা হয়। কী সেই পদ্ধতি মনে নেই।” মণিদেবী ও গৌতমবাবুর বক্তব্য, “সরকারি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠলে তদন্ত হওয়া উচিত। তা বলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সিপিএম নেতাদের নাম জড়ানোর চেষ্টা হলে, মানুষ বরদাস্ত করবেন না।”
অভিযোগকারীদের মন্তব্য, “জল দেওয়ার নামে টাকা জলে যাচ্ছে!”

সজলধারা কী?
অভিযোগের পাঁচকাহন
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও প্রকল্পের জায়গা বাছাই নিয়ে প্রশ্ন
গভীর নলকূপের সংখ্যা, পাইপের মান, ট্যাঙ্কের ধারণক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন
নলকূপের গভীরতা কম
নির্ধারিতের তুলনায় কমিউনিটি ট্যাঙ্ক, স্ট্যান্ড পোস্ট ও গৃহ-সংযোগ অর্ধেক
পাম্প হাউসে আসবাবের জন্য বরাদ্দ রয়েছে, আসবাব নেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.