ধামেশ্বর মহাপ্রভুর প্রশস্ত নাটমন্দিরে বসেছে কীর্তনের আসর। বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত বিগ্রহের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মধুক্ষরা কণ্ঠে এক কিশোরী গাইছেন রূপের পদ
“নবহু রুচি মেহ সখী
নিপহু মূলে পেখলু
নয়ন মন ভুলন মঝু ভরসং রে সখী।”
সেই সঙ্গে আখর দিয়ে দোহার ধরা হল, আমার নয়নমন সব ভুলে গেল, এই মোহন রূপে নয়ন দিয়ে, আমার নয়ন মন সব ভুলে গেল।”
শীতকাল। সন্ধাকাল। যেন গোষ্ঠে ফিরেছে বৃন্দাবনের সেই রাখাল। সেই সন্ধ্যা মনে থেকে গেল কীর্তনের শহর নবদ্বীপের। মনে থেকে গেলেন হরিপ্রিয়া ভৌমিক। এই ক’বছরে তিনি মন জয় করেছেন অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশারও। কাজটা সহজ নয়। কেননা, এই সব অঞ্চলেই কৃষ্ণ বড় পরিচিত নাম। তাঁর জীবনকর্ম নিয়ে সঙ্গীতের আসরও খুবই নিয়মিত। কোনও পদই সেখানে নতুন নয়। তার মধ্যেই কখনও মাথুর, কখনও মানভঞ্জন নিয়ে সেই মনও জয় করেছেন হরিপ্রিয়া।
শুরুটা কিন্তু তেমন ছিল না। বছর চোদ্দ আগে শ্রীবাস অঙ্গন ঘাট রোডের বাসিন্দা হরিপ্রিয়ার বিয়ে হয়েছিল বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের ব্যবসায়ী নির্মল ভৌমিকের সঙ্গে। ২০০৪ সালের অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিনে তিনি তখন বাপের বাড়িতে। খবর এল নির্মলবাবু মারা গিয়েছেন। সেই রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে আইন আদালত পর্যন্ত দৌড়োদৌড়ি করতে হয়েছিল। হরিপ্রিয়া শিশুকন্যাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারেননি। হরিপ্রিয়া বলেন, “বছর খানেক চলে গেল তারপরে। কিন্তু বাঁচতে তো হবে। ঠিক করলাম, স্বামীর ব্যবসা আমিই চালাব। স্বামীর সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ ছিল, তাঁদের সঙ্গে আমিও যোগাযোগ করলাম। তাঁরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন।” কলকাতার যে দোকান থেকে পাইকারি দরে বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম কিনতেন নির্মলবাবু, সেই সবই তিনি সেখান থেকেই কিনে নিয়ে আসতে শুরু করলেন। সে সব বিক্রির জায়গাও এক। কিন্তু একজন মহিলা সেই ব্যবসা করবেন, এমনটা কেউ ভাবেননি। হরিপ্রিয়া ভেবেছিলেন। সামলেও নিয়েছিলেন। কষ্ট কিছু কম ছিল না। প্রথমত ব্যবসাটা কী তাই বুঝতেন না। তার উপরে এত মানুষের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলার অভ্যাসটাই যে ছিল না। হরিপ্রিয়া বলেন, “আমি সবই শিখে নিয়েছি। তাতে সাহায্যও পেয়েছি।”
সেখান থেকে কীর্তনের আসরে কেন? হরিপ্রিয়া যে সুকণ্ঠী তা তিনি জানতেন। তাঁর বাবা মদনমোহন পোদ্দার এক জন কীর্তন শিল্পী। ছোট থেকে বড় হয়েছেন কীর্তনের পদ আখর শুনে শুনে। ব্যবসায় মোটামুটি পায়ের নীচে জমি পাওয়ার পরে সেই আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। তিনি কীর্তন গাইতে শুরু করলেন। ঠিক করলেন, প্রকাশ্যে প্রথম কীর্তনটি তিনি শোনাবেন মহাপ্রভুকে। সেই মতো সেই দিন রাতে তিনি গেয়েছিলেন রূপের সেই পদ।
ধীরে ধীরে বিখ্যাত হলেন। ব্যবসার পাশে পাশে সঙ্গীতের চর্চায় ডুবে রইলেন। সেই সঙ্গে ধরে রাখতে চাইলেন কীর্তনের আঙ্গিকের অখাদ ধরনটিও। সেই কারণেই ব্যবসার ক্ষতি হবে জেনেও সেই সঙ্গীতের চর্চায় ডুব দিলেন।
এখন সঙ্গীতের সঙ্গেই তাঁর সখ্য বেশি।
হরিপ্রিয়া বলেন, “গাইতে গাইতে মনে হয়, আমি যেন নিজের অন্তরের সঙ্গেই অন্তহীন এক সংলাপ বলে চলেছি।” |